রশীদ করীমের শতবর্ষ

সাহিত্যের  'উত্তম পুরুষ'

'আমি আদর্শ পুরুষ নই। আদর্শ পুরুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকুই এক নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা। সবটাই চির পরিচিত রেলগাড়ির লাইন; কোন স্টেশনে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়াবে তাও আগে থেকেই জানা। কোথাও অপ্রত্যাশিত বিস্ময় বা অজ্ঞতার চমক নেই। সুতরাং আমি আদর্শ পুরুষ নই। চরিত্র যথেষ্ট বলীয়ান নয় বলেও বটে, মনের স্বাভাবিক প্রবণতাও কিছুটা অন্যদিকে প্রবহমান বলেও বটে।' (উত্তম পুরুষ, ১৯৬১)

আধুনিক উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য বা স্বরূপ সন্ধান নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গবেষণা সন্দর্ভ লেখা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, আরও অনেক লেখা হবে, তর্ক-বিতর্ক চলবে। তবে একজন পাঠক হিসেবে মনে করি, আধুনিক উপন্যাস হলো বহুমাত্রিক আঙ্গিকের একটি জটিল মিশ্রণ, যা মূলত ব্যক্তির যাপিত জীবনের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত চিত্রটি অঙ্কন করে।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের 'উত্তম পুরুষ' পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, চল্লিশের দশকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতে দেশভাগের প্রেক্ষাপটের সমূহ ধারণা নিয়ে একদম আজকের দিনে বসে লেখা কোনো উপন্যাস। লেখার ভাষা এতটাই প্রাঞ্জল ও সাবলীল যে, তা ষাটের দশকে জন্ম নেওয়া সাহিত্য—এই কথা বিশ্বাস করা দুষ্কর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের মতো গত শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে লেখা বলে এই উপন্যাসটি বাংলার রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি সবকিছু ভাঙা-গড়ার এক অদ্ভুত খেলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। উপন্যাসটি তার নামের যথার্থতা রক্ষায় লেখকের নিজের জবানিতে 'শাকের' নামে একটি চরিত্রকে ধারণ করে আগায়। শাকের তৎকালীন কলকাতার একজন সাব-ডেপুটির কনিষ্ঠ সন্তান। নিম্ন-মধ্যবিত্ত টানাটানির সংস্কারে মেধাবী শাকেরের জীবনে নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সন্তান মুশতাকের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে বন্ধুত্বের মাধ্যমে। মুশতাকের বাড়ি ও তার পরিবারকে ঘিরে রশীদ করীম চিত্রায়ন করেন কলকাতার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের। মুশতাকের মায়ের পোশাক, খেতে দেওয়া নাশতা, বাড়ির আসবাব ও তার বোনের আচরণ—এই সবকিছু ঘিরে শাকের নিজেকে নতুন করে জানতে পারে। বুঝতে পারে সে কতটা আলাদা আর কতটা অচ্ছুত।

স্কুলে ভর্তির পর বন্ধু কাঞ্জিলাল, শেখর, সলীলদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে শাকের নিজেকে চিনতে পারে আরও একবার। হিন্দু বন্ধুর কাছ থেকে পানি খাওয়ার মত ক্ষুদ্র বিষয় থেকে শুরু করে বন্ধু শেখরের বাড়িতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে নানা অভিজ্ঞতা শাকেরকে নিজের পরিচয় নিয়ে আরও সতর্ক করে তোলে।

এতে প্রেমে ব্যর্থতা দারুণভাবে শাকেরকে তার দুটি সীমাবদ্ধতাকে চিনিয়ে দেয়। মুশতাকের বোন সেলিনার নির্দয় আচরণ ও একপর্যায়ে ভয়ংকর প্রতারণা তাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। অদ্ভুত রকমের অনিশ্চয়তার মধ্যে সেলিনাকে বিশ্বাস করা, তাকে পাওয়ার সম্ভাবনায় শাকের ভুলতে বসে তাদের মধ্যকার পার্থক্যটুকু। বিভিন্ন ঘটনায় সেলিনাকে নিজের সবটুকু দিয়ে শাকের ভাবে, সে বুঝি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েই গেল। যখন তার স্বপ্নভঙ্গ হয়, তখন আবার নিজেকে অন্যরূপে খুঁজে পায়।

অন্যদিকে বন্ধু শেখরের বোন চন্দ্রার সঙ্গে শাকেরের প্রণয় যেন ছোটগল্পের মতো শুরু হওয়ার আগেই শেষ। শেখরের পরীক্ষার ফি জোগাড় করার জন্য যেই শাকের সেলিনার দেওয়া উপহারের দামি কলমটি বিক্রি করে কাঞ্জিলালের কাছে, সেই শাকেরকে তাদের বাড়ি আসতে নিষেধ করে শেখরেরই বোন চন্দ্রা। শাকের জানতে পারে হিন্দু বাড়িতে তার আসা যাওয়া এলাকায় নানান কথার চল উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দারিদ্র্যে শেখরের মা-বাবার নৈতিক স্খলন ও চন্দ্রাকে তার স্কুলেরই ধনী বন্ধু সলীলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে পাওয়া যেন প্রেম-প্রণয়ে শাকেরের সবটুকু বিশ্বাস ও শক্তি শুষে নেয়। এই দুটি ব্যর্থ প্রণয়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গী হয়ে পাঠক জানতে পারে শাকেরের দারিদ্র্য ও মুসলমান চরিত্রের সংমিশ্রণ শাকেরের জীবন কতটা দুর্বিষহ করে তোলে।

আড্ডায় রশীদ করীম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুজ্জামান খান, ভূঁইয়া ইকবাল ও আনিসুজ্জামান; ১৯৯১, শাহজাদপুর। ছবি ফেসবুক থেকে

পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন ও বিভিন্ন সংকীর্ণতায় নির্জীব শাকের নিজের কর্তৃত্ব অনুভব করে রাজনীতিতে একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে। মুশতাকের বাড়ির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শাকের জোর কণ্ঠে হিন্দু সমবয়সী আরেক বন্ধুর সঙ্গে বিতর্ক চালিয়ে যায়। জিন্নাহর কট্টর সমর্থক শাকের দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেয়। বোঝানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কেন তার জন্য জরুরি। রশীদ করীম এখানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিম শাকের ও ধনী পরিবারের সেলিনা-মুশতাকদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার পার্থক্য দারুণভাবে বাইনারি চিত্রায়ন করে দেখান, দেশভাগে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানো চরিত্রগুলো দেখতে কেমন। শাকেরের জীবন-বাস্তবতা পাঠককে বোঝায় দেশভাগের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন জটিল ও তাত্ত্বিক তর্কগুলো কীভাবে জীবনের সাবলীল ঘটনাপ্রবাহেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বালীগঞ্জ-টালিগঞ্জ-কলকাতার নাগরিকতার জীবন, সিনেমা, আড্ডা, কফিহাউস, রেস্টুরেন্ট—সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি তৎকালীন কলকাতাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে। শুধু কলকাতার জীবনই নয়, এই উপন্যাসটি পড়লে এটিও বোঝা যায়, গত শতকের কলকাতা আর ঢাকা কাছে থেকেও কতটা দূরে। কলকাতার চলাফেরা, চিন্তা ও চলতি সংস্কৃতির সবকিছুই যেন ঢাকার থেকে অনেক বেশি আধুনিক। 'উত্তম পুরুষ' পড়ার সময় এটা আজকালকার দিনে লেখা উপন্যাস মনে হওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ।

কলকাতায় চল্লিশের দশকের যে জীবনের বর্ণনা সেখানে পাওয়া যায়, সেটার সঙ্গে ঢাকায় আমাদের আজকালকার জীবনের খুব একটা পার্থক্য নেই। মনে হবে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, জন্মদিনের পার্টি করা সবকিছুই যেন আজকের পাঠকের যাপিত জীবন।

রশীদ করীম ১৯২৫ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়ার স্কুলের প্রথম যে ৪ জন ছাত্রী ছিলেন তারা আর কেউ নন, রশীদ করীমের মা-খালারাই। বেগম রোকেয়া স্কুল করার জন্য যে জায়গাটি পেয়েছিলেন, তার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন রশীদ করীমের নানা।

পাঠক হয়ত বুঝতে পারছেন, কালের পরিক্রমায় চাপা পড়ে যাওয়া রশীদ করীমের পরিবারের বাঙালি মুসলমানের আলোকায়নে কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন। যে উপন্যাসটি নিয়ে আজকের এই লেখা, সেই উপন্যাসটিও তৎকালীন পাকিস্তানের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। শামসুর রাহমান বলেছিলেন, 'রশীদ করিম আমাদের দেশের অন্যতম সেরা গদ্যকার। তার উত্তম পুরুষ উপন্যাসের ভাষা আশ্চর্য সহজ-সরল ও আধুনিক। রশীদ করিমকে আমি আমার সেরা বন্ধু মনে করি।'

আজকের দিনে যখন ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানে মুসলিম প্রশ্নটি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে; এনআরসি, সিএএ, ওয়াকফ্ বিলের পর এখনো ভারতে মুসলিমরা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই প্রেক্ষাপটে ৪৭-এর মুসলিমকে বুঝতে রসদ যোগাবে 'উত্তম পুরুষ'।

যে তথ্য না জানালেই নয়—২০২৫ অর্থাৎ চলছে বছর রশীদ করীমের জন্মশতবর্ষ। বলা যায় অনেকটা অনাড়ম্বরেই কেটে যাচ্ছে। এর মাঝে রশীদ করীমের খোঁজ পেলাম খিলগাঁও ইসলামী পাঠাগারের রশীদ করীমের জন্মশতবর্ষ আয়োজনে। এই পাঠাগারকে ধন্যবাদ তাঁর স্মরণ প্রসঙ্গে আমাদের যুক্ত করে দেওয়ার জন্য।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

5h ago