অনুভবের যৎসামান্য (১৩)

মায়ের মুখের ভাষা 

আমাদের বাড়িতে একজন দেহাতি মহিলা ছিল, গৃহকর্মী। তখন অবশ্য গৃহকর্মী শব্দটা চালু হয়নি, আমরা বলতাম- কাজের মানুষ। দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবতী, প্রাণবন্ত এবং শক্তিশালী। তার চলাফেরা, কাজকর্ম, কথাবার্তার মধ্যে সেই শক্তিমত্তার প্রকাশও ঘটতো। নিচু কণ্ঠে কথা সে বলতেই পারতো না, ধীরেসুস্থে হাঁটতেও পারতো না, দুপদাপ পা ফেলে প্রায় দৌড়ে চলতো সে। এরকম হাঁটা নিয়েই মা'র আপত্তি ছিল। বলতেন, 'ও ফুলজান, অত জোরে হাঁটিস না, মাটি ব্যথা পায়।'

শুনে আমি কান খাড়া করতাম। মাটি ব্যথা পায়? তা কেমন করে সম্ভব? মাটির কি প্রাণ আছে? মাকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, 'পায় রে বাবা, সব জিনিসই ব্যথা পায়।' ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতো না (এখনো ঢোকে না), জড়পদার্থ আবার ব্যথা পায় কীভাবে? 

জীবজন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গ এমনকি জড়পদার্থের জন্যও মা'র ছিল ভীষণ মায়া। রাতের বেলায় বাড়ির বাগান থেকে লেবু বা মরিচ বা অন্য কিছু আনতে গেলে মা বলতেন, 'গাছকে বলে আনিস।' গাছকে বলবো? এ আবার কেমন কথা? গাছ কি মানুষের কথা বোঝে? কীই-বা বলবো ওকে? কিন্তু বুঝি আর না বুঝি, মা'র কথা অমান্য করার সাহস বা ইচ্ছে নেই, তাই তার শেখানো কথাই বলতাম – 'গাছ ভাইয়া, তোমার কাছ থেকে একটা লেবু নিলাম!' 

এসবের আগে, বেশ ছোটবেলায়, একবার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ঝগড়া লেগে গেল, কিঞ্চিৎ মারামারিও। হেরে গেলাম। কিন্তু এই হার তো মেনে নেয়া যায় না। মনে হলো, আমার কোনো দোষ নেই, দোষ ওদেরই। বলে বসলাম, 'আল্লার কাছে বিচার দিলাম, দেখিস তোদের কী হয়!' এই কথা যে মা'র কানে যাবে, তা কি আর জানতাম? আর গেলেই কী? মন্দ কিছু তো বলিনি! মা শাসন করতেন মৃদুকণ্ঠে, তাও সবার সামনে নয়, একা একা। তখনও রাতে মায়ের কাছে ঘুমাই। সারাদিনের কাজ শেষে মা তখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, তবু গল্প শুনতে চাইতাম, আর মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, 'জীবনটাই তো এক গল্প বাবা, তোকে কোন গল্প বলবো?' ওই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যে গোপন দুঃখ মেশানো থাকতো, সেই ছোটবেলায়ও তা বুঝতে পারতাম বলে গল্প আর শোনা হতো না। কিন্তু সেদিন গল্প শোনার আবদার করলে তিনি এক অদ্ভুত গল্প শোনালেন। 

গল্পটা এরকম : এক বাড়িতে এক গরিব মহিলা কাজ করতো। তার ছিল একটামাত্র ছেলে। মনিবেরও একটা ছেলে ছিল একই বয়সের। দুজনে একসঙ্গে খেলা করতো। খেলতে গেলে তো ঝগড়া লাগেই, ওদেরও লাগতো এবং মনিবের ছেলে প্রায়ই গরিব ছেলেটাকে মারতো। মার খেয়ে সে আসতো তার মায়ের কাছে। কিন্তু ওর কী করার আছে, ও তো কাজের মানুষ! একবার ভীষণভাবে মার খেলো ছেলেটা। রক্তারক্তি ব্যাপার। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এলো সে। ছেলের অবস্থা দেখে সেও কেঁদে ফেললো, চিৎকার করে বললো, 'আল্লাহ, আমরা গরিব মানুষ। আমাগো কেউ নাই তুমি ছাড়া। তোমার কাছে বিচার দিলাম, তুমি এর বিচার কইরো।' 

সেই রাতেই ছেলেটার জ্বর এলো। দিন দিন বেড়েই চললো সেই জ্বর, কত ওষুধ-পথ্য, কত ডাক্তার-কবিরাজ, কিছুতেই সারলো না। এক সপ্তাহের মাথায় ছেলেটা মারা গেল। ওর মা এবার আহাজারি করতে লাগলো, 'তোমার কাছে বিচার চাইছিলাম আল্লা, আর তুমি আমার পোলাডারে কাইড়া নিলা! এই তোমার বিচার?' কয়েক দিন ধরে চললো এই আহাজারি আর আল্লাহকে দোষারোপ। তারপর এক রাতে সে স্বপ্ন দেখলো, এক ফেরেশতা এসেছে তার কাছে। বলছে, 'তুমি তো আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছিলে, তিনি বিচার করেছেন। তাহলে কান্নাকাটি করো কেন?' সে স্বপ্নের মধ্যেই কেঁদে বললো - 'মাইর খাইলো আমার পোলা, আমি তো সেইজন্য বিচার চাইলাম, আর আল্লাহ আমার বুকের ধন কাইড়া নিলো! এইটা কিমুন বিচার? এইডারে সুবিচার কয়?' ফেরেশতা বললো, 'মনে করে দেখ তো, তুমি কারো ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলেছিলে কি না!' মহিলা তো অবাক। বললো, 'কই না তো! আমি তো কাউকে মারি নাই।' ফেরেশতা তখন বললো, 'সেদিন রান্নাঘরে একদল পিঁপড়াকে তুমি পায়ে পিষে মেরে ফেলোনি?' মহিলার তখন হুঁশ হলো - 'হ মারছি, ওরা তো পিঁপড়া, মানুষ তো না।' ফেরেশতা বললো, 'তাতে কী? ওরাও তো আল্লাহর সৃষ্টি, ওদেরও তো মা আছে। ওদের মাও তো আল্লাহর কাছে তোমার নামে বিচার চাইতে পারে!'

মা থামলেন, আর আমি শিউরে উঠলাম। পিঁপড়া মারার অপরাধে এরকম শাস্তি! মা তখন মৃদু কণ্ঠে বললেন, 'আল্লাহর কাছে কখনো বিচার চাইতে হয় না বাবা। আমাদের কত ভুলত্রুটি হয়, জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে কত অন্যায় করি!  আল্লাহ হয়তো সেগুলো ক্ষমা করে দেন। কিন্তু বিচার চাইলে তখন সেই অন্যায়গুলো আবার খুঁটিয়ে দেখেন। তিনি তো সুবিচারক, সূক্ষ্ণ বিচারক। কোন ভুলের যে কী শাস্তি হয়, তা তো বোঝার উপায় নাই।'

আমি বুঝে গেলাম, খেলতে গিয়ে ঝগড়ায় হেরে আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছিলাম, সেই প্রেক্ষিতেই গল্পটা বলা হলো। তারচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল, পিঁপড়ার মতো অতি ক্ষুদ্র এক প্রাণীরও যে গুরুত্ব আছে, তার জীবনও যে অন্য সবার জীবনের মতোই মূল্যবান, সেটি বুঝতে পারা। 

এসব আমার স্কুল-পড়ুয়া বয়সের ঘটনা। এরও অনেক পরে, মাহমুদুল হকের 'কালো বরফ' উপন্যাসে পড়লাম :   'কাউকে না জানিয়ে, খুব গোপনে, টু-শব্দটি না করে, হাসিমুখে, কি অবিরল নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলো মা। সংসারের সামান্য একটা ফাটা পিরিচ, কিংবা ডাঙ ভাঙা কাপ, কিংবা ক্ষয়ধরা পেতলের খুন্তির গায়েও চোখের পানি ছিল মা'র। এমন কিছুই ছিল না, যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা কখনও সংসারের কোনো কাজে লাগবে না। সবকিছু ছিলো আদরের। পুরনো পাড় থেকে তোলা সামান্য যে পচা সুতো তারও যে যত্ন ছিল, তাতে জীবনের ভার অনেকখানি লাঘব হয়। তুচ্ছ কুটোগাচা থেকে হাত-বেড়ি-খুন্তিরও অভিমান ছিল, তারাও বোধহয় মা বলে ডাকতে শিখেছিল। মনে হতো অপরাধী, ঘটিবাটির কাছে, ঘরদোরের কাছে, বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষকের কাছে। সামান্য যে ফেনফেলা গামলা, হাঁড়িধরা ন্যাতা, ঘরপোছা ন্যাতা, তিল তিল করে সে অপরাধের কথা তাদেরও বোধহয় এক সময় জানা হয়ে যেতো।'  

আমার চোখ ভরে উঠলো জলে, মনে হলো– আমি আমার মায়ের দেখা পেলাম এই লেখার ভেতরে। আমার মা'র কাছেও কিছুই ফেলনা ছিল না । না মানুষ, না জীবজন্তু, না কীটপতঙ্গ, না গাছপালা, না জড়পদার্থ। সবকিছুই যেন আমার মাকে 'মা' বলে ডাকতে শিখেছিল। 

কালো বরফ পড়ে কেবল আমারই এরকম মনে হয়নি, আরো অনেকের হয়েছে। একটা ঘটনা বলেছিলেন মাহমুদুল হক। তার মুখেই শোনা যাক :  উপন্যাসটা বই হয়ে বেরুনোর অনেকদিন পর আমি কুমিল্লা অভয়াশ্রম থেকে একটা চিঠি পেলাম, এসেছিল প্রকাশকের ঠিকানায়। খুবই কাঁচা হাতের লেখা চিঠিটাতে একটা বাক্য ছিল – 'আপনার কালো বরফ পড়িয়া আমার মাতৃদর্শন ঘটিয়াছে।' চিঠিটা পড়ে আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম, কেঁদেছিলামও। এ-তো আমারও মাতৃদর্শন। আমার লেখক জীবনে যা কিছু বড়ো প্রাপ্তি তার মধ্যে এই চিঠি একটি।'

কেন পাঠকরা এই মায়ের মধ্যে নিজের মাকে দেখতে পান? কারণ, আমার মনে হয়, আমাদের মায়েরা মোটামুটি এরকমই ছিলেন। মাহমুদুল হকও স্বীকার করেছিলেন, কালো বরফের মায়ের সঙ্গে তার মায়ের বেশ খানিকটা মিল আছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম : 'আপনার আর কোনো লেখায় কি আপনার মাকে পাওয়া যাবে?' উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'খেলাঘর উপন্যাসটার ভাষা আমার মায়ের মুখের ভাষা থেকে নেয়া। সংলাপগুলো খেয়াল করে দেখো, ওই ভাষায় আমি বা আমার চারপাশের কেউ-ই কথা বলে না। মা ওই ভাষায় কথা বলতেন।'

মায়ের কথা, মায়ের ভাষা বোধহয় কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের ভেতরে রয়েই যায়। সৈয়দ শামসুল হকও একবার 'পরানের গহিন ভিতর' লেখার নেপথ্য গল্প বলতে গিয়ে মায়ের মুখের ভাষার কথা বলেছিলেন। গল্পটা এরকম : 'আঞ্চলিক ভাষায় গভীর কিছু বলা যায় কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলাম একসময়। আমার মা মানিকগঞ্জের, আমার পিতৃপুরুষেরা সিরাজগঞ্জের আর আমার জন্ম কুড়িগ্রামে। তিনরকম আঞ্চলিক ভাষার ভেতর দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। তারপর আমার আঠারো বছর বয়সে বাবা যখন চলে যান, আমার ছোট সাতটা ভাইবোন, আমি সবার বড়। 

মায়ের সঙ্গে সাতটা ভাইবোনকে মানুষ করেছি একসঙ্গে, সংসার পরিচালনা করেছি ভাইবোনের মতো। মা যেন তখন আর মা নন, আমরা যেন দুটি ভাইবোন, সংসারটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। তো তখন মাঝে মাঝে সারাদিনের শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আমি যখন ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম যেতাম কয়েকদিনের জন্য, মার সঙ্গে সেই বারান্দায় দেখছি বসে, গভীর রাতে, অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। আকাশে হয়তো তারা, আকাশে হয়তো চাঁদ কিংবা অমাবস্যা, মাও সেদিকে তাকিয়ে, আমিও তাকিয়ে, বলে যাচ্ছি কথা, একবারে ভেতর থেকে। একটা সময় আমার মনে হলো, এই যে আমি মার সঙ্গে মানিকগঞ্জের ভাষায় কথা বলছি, উপভাষায়, কবিতায় এটা পরীক্ষা করে দেখা যায় কি না। ... তো প্রথমেই যে কবিতাটি লিখি, সেটিই পরানের গহীন ভিতর।'

প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দোজার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও মাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। কেমন সম্পর্ক ছিল মা-ছেলের, কী নিয়ে আলাপ করতেন, কীভাবে মা তাকে বুঝতে পারতেন, সব। জানিয়েছিলেন, 'গত বারো বছর হলো, যখন থেকে আমার সামর্থ্য হয়েছে, আমি তাকে প্রতি রোববার একই সময় ফোন করি – তা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকি না কেন। লোকে বলে আমি খুব দায়িত্বশীল ছেলে, আসলে তা নয়। আমার পরেরজনের চেয়ে আমি বেশি ভালো ছেলে নই। কিন্তু আমি ফোন করি, কারণ প্রতি রোববারে ফোন করাটা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই একটা অংশ।'

তার উপন্যাসের গোপন রহস্যও যে মা আবিষ্কার করতে পারতেন, সেটি বলেছিলেন এভাবে : 'আমার সব পাঠকের মধ্যে তার অনুভূতিই সবচেয়ে চোখা এবং নিশ্চিতভাবে তিনিই জানেন কোন চরিত্রের পেছনে কোন আসল মানুষটির কায়া বর্তমান। কারণ আমার সব চরিত্রই বিভিন্ন ধরনের বাস্তব মানুষের এবং স্বাভাবিকভাবেই আমার নিজের চরিত্রেরও জগাখিচুড়ি। এ ক্ষেত্রে আমার মায়ের অনন্য প্রতিভা হলো এই যে, তিনি একজন পুরাতাত্ত্বিকের মতো মাটি খুঁড়ে পাওয়া মেরুদণ্ডের সামান্য হাড়গোড় থেকেও জন্তুটার পূর্ণাঙ্গ আকার দাঁড় করাতে পারেন। আমার বই পড়ার সময় তিনি খুব সহজাতভাবে সমস্ত আরোপিত অংশগুলো ছেঁটে ফেলে মূল মেরুদণ্ডাংশকে, যার চারপাশ ঘিরে আমি চরিত্রকে গড়ে তুলেছি, তা দেখিয়ে দিতে পারেন। মা যখন পড়েন, তখন কখনো কখনো তাকে বলতে শুনবেন, 'আহারে আমার বেচারি বন্ধু, এই জায়গায় এসে তাকে একেবারে হিজড়ে বানিয়ে ছেড়েছে।' আমি বলি যে না, আসলে তা নয়, তার বন্ধুর মতো নয় মোটেও ওই চরিত্র। কিন্তু আমার বলা কেবল বলার খাতিরেই, কারণ তিনি জানেন যে আমি ঠিকই জানি তার কথাই ঠিক।'

কী সুন্দর এই সম্পর্ক, কী গভীর! হ্যাঁ, আমরা যত বড়োই হই না কেন, মা আমাদের বুঝতে পারেন। মায়ের কথা, মায়ের ভাষা, মায়ের শিক্ষা আমাদের ভেতরেই রয়ে যায়। সেজন্যই কি নিজের দেশকে আমরা বলি মাতৃভূমি? নিজের ভাষাকে বলি মাতৃভাষা? দেশ আর ভাষা তো মায়ের মতোই, সমস্ত বিপর্যয়েও সদাসর্বদা আমাদের জড়িয়ে রাখে গভীর মমতায়, আমাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়।   

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

10h ago