ঝরে পড়া বিবর্ণ তারা ইরানি কবি পারনিয়া

পারনিয়া আব্বাসি । ছবি: সংগৃহীত

'হাজার জায়গা ঘুরে
আমি শেষ হতে এসেছি
আমি পুড়ি
আমি বিবর্ণ তারকা
যা, উধাও হয়ে যায়
তোমার আকাশে।'

এই ছোট কবিতাটি লিখেছিলেন পারনিয়া আব্বাসি। তিনি ইরানের তরুণ কবি। চব্বিশতম জন্মদিনটাও পালন করা হলো না তার। জ্বলে ওঠার আগেই নিভে গেলেন। তার লেখা কবিতার মতো তারা হয়ে গেলেন ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে।

গত ১৩ জুন ইসরায়েলের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিম তেহরানের সাততারখান এলাকায় তার বাড়িতে আঘাত হানে। তাতে পারনিয়া নিহত হন বাবা, মা ও ১৬ বছর বয়সী ছোট ভাই পারহামের সঙ্গে। তিনি ২৪তম জন্মদিন উদযাপন করার আগেই নিহত হন।

পারনিয়া একজন তরুণ কবি ছিলেন। তার সঙ্গে কোনো সামরিক সংস্থার যোগাযোগ ছিল না। তিনি কাজভিন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি অনুবাদ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইংরেজি শেখাতেন। সম্প্রতি এই তরুণ কবি ব্যাংক মেল্লিতে চাকরি শুরু করেছিলেন।

তার এক বন্ধু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেন, 'সে খুব ভালো মানুষ ছিল। তার ইচ্ছে ছিল একজন বড় কবি হওয়া। তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের ছিল কবিতা আবৃত্তি করা। অসংখ্য কবিতা মুখস্থ ছিল তার। এজন্য আমি তাকে প্রায়ই হিংসা করতাম।'

পারনিয়া আব্বাসির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইসরায়েলপন্থীরা ও ইরান সরকারের বিরোধীরা তাকে নিয়ে মিথ্যা দাবি তুলেছিল। তারা বলেছিল, পারনিয়া ছিলেন ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফারেইদুন আব্বাসির মেয়ে। তারা এটাও বলেছিল, পারনিয়া তার সঙ্গে নিহত হয়েছেন।

কিন্তু পরে জানা যায়, তাদের এই দাবি ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। ফারেইদুন আব্বাসির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না পারনিয়ার। তার বাবার নাম পারভিজ, তিনি ব্যাংক মেল্লির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। ওই ইসরায়েলি হামলায় পারনিয়ার ছোট চার সদস্যের পরিবারের সবাই নিহত হন। অথচ তারা সবাই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।

ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাদের ভবন ধসে পড়ায় তার মরদেহ উদ্ধার করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ওই হামলা সাততারখানের একটি দশ ইউনিটের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ব্লক ৪-এ আঘাত করে। ধ্বংস করে দেয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ওই তলাগুলোর প্রায় সব বাসিন্দা নিহত হয়েছেন।

পারনিয়ার এক আত্মীয় বলেন, 'সাধারণত মানুষ সাহিত্য কিংবা গণিতে ভালো হয়—দুটোতে একসঙ্গে নয়। কিন্তু সে দুটোতেই ভালো ছিল। সাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসা প্রবল ছিল, সবসময় কবিতার বই হাতে নিয়ে ঘুরত।'

তবে পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি পারনিয়ার এই আত্মীয়। তিনি আরও বলেন, 'তার বাবা বহু বছর ব্যাংকে কাজ করেছেন। তাই ব্যাংকের চাকরির প্রতি তার টান ছিল। স্বপ্ন ছিল ব্যাংকে কাজ করার। শেষ পর্যন্ত সে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল।'

সামাজিকমাধ্যমে পারনিয়ার রক্তরঞ্জিত গোলাপি বিছানার চাদরের একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। দেওয়াল ধসে পড়া বিছানার চাদরের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। ছবিটি অনেককে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে। তিনি দ্রুতই ইসরায়েলের হামলায় বেসামরিক নাগরিক হত্যার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তবে কারো কান্নার শব্দ নেতানিয়াহুর কান পর্যন্ত পৌঁছেনি।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগেই দাবি করেছিলেন, তারা কেবল ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছেন। তবে বাস্তবে বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।

১৭ জুন গ্রিন মুভমেন্ট নেত্রী ও মীর হোসেন মুসাভির স্ত্রী জাহরা রাহনাভার্দ ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে পারনিয়ার নাম উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, 'নারীরা সবসময় প্রথম বেসামরিক নাগরিক হত্যার শিকার হয়। পারনিয়া আব্বাসির মতো তরুণ কবি ও অনুবাদক থেকে শুরু করে আরও বহু নারী জীবন হারিয়েছে ইসরায়েলের নারীহত্যা, শিশুহত্যা আগ্রাসনের কারণে।'

ইসরায়েলের হামলায় কেবল পারনিয়া নিহত হননি। কিন্তু একজন সম্ভাবনাময় তরুণ কবি হিসেবে তার ছবি ও গল্প বিশ্বের মানুষের আবেগ ছুঁয়েছে। কেবল ছুঁতে পারেনি ইসরায়েলি বাহিনীদের।

তার কবিতায় মতোই তিনি শেষ হয়ে গেলেন, পুড়ে ছাই হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেলেন বিবর্ণ তারার মতো।

পারনিয়ার সেই বন্ধু বলেন, 'তারা বলেছে, শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। তারা বলেছে, শুধু পারমাণবিক স্থাপনাই টার্গেট? তাহলে আমাদের প্রিয় পারনিয়া কেন নিহত হলো?'

একজন তরুণ কবির এই মৃত্যুর ব্যাখ্যা কী?

Comments

The Daily Star  | English

Students’ unions: Legal bars, admin delays stall polls in many universities

Of 56 public universities across the country, only seven have the legal provision for a central students' union

7h ago