শতবর্ষে রিজওয়ান লাইব্রেরি, নষ্টের পথে ৩০ হাজার বই

শতবর্ষে রিজওয়ান লাইব্রেরি, নষ্টের পথে ৩০ হাজার বই, ছবি লেখক

বইয়ের সঙ্গে পাঠকের আত্মিক সম্পর্ক করে সমাজ এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্নে প্রখ্যাত কবি ও নজরুল গবেষক তালিম হোসেন নিজ জন্মভূমি নওগাঁয় গড়ে তুলেছেন 'রিজওয়ান লাইব্রেরি'। এতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকের জন্য রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বই, ম্যাগাজিন ও পত্রিকা। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন এই সংগ্রহশালা কালের সাক্ষী হয়ে শতবর্ষ পার করছে। কিন্তু অযত্ন-অবহেলা আর যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ৯০ বছর বয়সী এই গ্রন্থাগারের অমূল্য বই, দুষ্প্রাপ্য প্রকাশনা।

কবি তালিম হোসেনের পরিবার ও লাইব্রেরি সূত্রে জানা যায়, তালিম নিজ গ্রামের মানুষদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালে স্থাপন করেন চাকরাইল রিজওয়ান লাইব্রেরি। এটি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চাকরাইল গ্রামে অবস্থিত। নওগাঁয় রিজওয়ান লাইব্রেরি নামেও পরিচিত। এখানে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়, যা স্থানীয় ছাড়াও বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্য বিষয়ক চাহিদা পূরণে সহায়ক। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে ২৮-৩০ হাজার বই সংরক্ষিত আছে। রয়েছে তালপাতায় লেখা পুঁথি ও শত শত বছরের পুরোনো বইও।

সরেজমিনে দেখা যায়, নওগাঁ জেলা থেকে বদলগাছী যেতে শাখা রোডের সঙ্গেই রিজওয়ান লাইব্রেরি। আঙিনায় রয়েছে ইউনিয়ন অফিস, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। ১০ শতক জায়গায় লাইব্রেরির অবস্থা খুবই নাজুক। দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না করায় বর্তমানে লাইব্রেরির টিনশেডের ভবনের ভেতর কাঠের ৩০টি আলমারি ঘুণপোকায় নষ্ট করছে, স্টিলের আলমিরায় মরীচিকা পড়েছে। মাঝে মাঝে বই কেটে নষ্ট করছে ইঁদুর, ধুলোয় কয়েক আস্তর জমা, এরকম বহু সমস্যায় জর্জরিত। যদি বিত্তশালী বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়, তাহলে এই লাইব্রেরি সংস্কার করা যাবে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরি অনেক গবেষকের কাজে লাগবে। এর কয়েক বাড়ি পরেই আছে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর, যা কবির স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

নানান সংকটের মাঝেও বদলগাছী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত শতবর্ষী লাইব্রেরি এখনো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই লাইব্রেরিতে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া স্পর্শ না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে  অনেক বই। বলা যায়, সংস্কার ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে শত শত বছরের ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখানে রয়েছে মূল্যবান সাময়িকী ও তালপাতায় লেখা পুঁথি। 

লাইব্রেরির তাকে দেখলাম কাজী নজরুল ইসলামের একটি জনপ্রিয় বই 'গুলবাগিচা',  মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ', নিমাই ভট্টাচার্যের 'মিনিবাস', জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা', তালিম হোসেন 'নূহের জহর', ফরহাদ মজহারের 'আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে' বইগুলোর প্রথম সংস্করণের কপিও রয়েছে।

পাঠাগার পরিচিতে লেখা আছে—কবি তালিম হোসেনের সঙ্গে এলাকাবাসীর অক্লান্ত শ্রম, ত্যাগ ও অর্থে, দান দক্ষিণায় চাকরাইল রিজওয়ান লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত। নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, খায়রুল বাশার চৌধুরী ও কবির বাবা সাহিত্য প্রচেতা তৈয়ব উদ্দিন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। লাইব্রেরির আহ্বান—এসো আমার কাছে—হয়তো শুধুহাতে ফিরবে না, আমি আজ দিতে পারি তোমাদের প্রয়োজনে।

রিজওয়ান লাইব্রেরিতে বইগুলোর প্রথম সংস্করণের কপিও রয়েছে।

লাইব্রেরির তাকে দেখলাম কাজী নজরুল ইসলামের একটি জনপ্রিয় বই 'গুলবাগিচা',  মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ', নিমাই ভট্টাচার্যের 'মিনিবাস', জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা', তালিম হোসেন 'নূহের জহর', ফরহাদ মজহারের 'আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে' বইগুলোর প্রথম সংস্করণের কপিও রয়েছে।

লাইব্রেরির পরিদর্শন খাতা থেকে জানা যায়, গত মাসে সেখানে গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির গবেষক মামুন সিদ্দিকী। লাইব্রেরিতে এসে সংগ্রহ দেখে মুগ্ধতার কথা জানান। এছাড়াও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত লিখতে এই লাইব্রেরির সাহায্য নিয়েছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হকও গবেষণার কাজে এখানে এসেছিলেন। এমন অনেক কীর্তিমানদের আনাগোনা ছিল রিজওয়ান লাইব্রেরিতে।

নওগাঁ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশ-বিদেশের বহু গবেষক এখানে আসেন বিভিন্ন গবেষণার জন্য। এছাড়াও সাধারণ পাঠকের উপযোগী ইংরেজি সাহিত্যসহ জীবনগ্রন্থ, ইতিহাস, ভ্রমণবৃত্তান্ত, উপন্যাস, বই এখানে আছে। গ্রন্থাগারের দুর্লভ বইগুলো জাতীয় সম্পদ এবং এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাই। এখনো অনেক গবেষক ও শিক্ষানুরাগী এখানে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে।

বাংলার অধ্যাপক গবেষক ড. শামসুল ইসলাম বলেন, নওগাঁ ইতিহাসসহ সাহিত্যের অনেক গবেষণায় এই লাইব্রেরি ব্যবহার করেছি। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। জাতীয় আর্কাইভ ভাবনা থেকে আধুনিকায়ন করলে দুর্লভ বই ও পুঁথিগুলো সংরক্ষণ থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবে। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার যত্ন না নিলে গ্রন্থাগারটি আরও বেহাল হয়ে পড়বে। একটু আন্তরিকতা পেলে শত বছরের পুরোনো বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক এই নিদর্শনগুলো আগামীর শত শত বছরের জন্য কালের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো।

রিজওয়ান লাইব্রেরিতে লাইব্রেরি সম্পর্কে জানাচ্ছেন কবির ভাতিজা রকিব চৌধুরী, ছবি স্টার

কবি তালিম হোসেনের মেয়ে শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী বলেন, আব্বার প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিতে অনেক মানুষের আনাগোনা ছিল। এখন সময় বদলে গেছে, বইয়ের প্রতি মানুষের টানও কমে গেছে। তথাপি স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসকদের আরও নজর পড়লে এটি নতুনভাবে দাঁড়াতে পারে। আমরা তো সঙ্গে আছি, থাকব।

পাঠাগারে কথা হয় কবির ভাতিজা রকিব চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, কবি তালিম হোসেন বংশের পদবী চৌধুরী তাঁর লেখালেখি বইতে ব্যবহার করতেন না। ব্যক্তি জীবনে খুব অমায়িক মানুষ ছিলেন। অনেক স্নেহ পেয়েছি আমি। গ্রামে এলেই সবাইকে নিয়ে আড্ডা বই পড়ায় মশগুল থাকতেন। রিজওয়ান লাইব্রেরি নিয়ে চাচার অনেক স্বপ্ন, আত্মীয়দের পাশাপাশি গ্রামের মানুষদের এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এমন সমাজ, বইপাগল মানুষ আর হবে না। তাঁর স্মৃতির রক্ষার্থে নওগাঁ শহরে একটা সড়কের নাম বা সরকারি কলেজের ভবনের নাম হতে পারে। 

রিজওয়ান লাইব্রেরির সম্মুখে নওগাঁ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম ও ড. শামসুল ইসলাম

এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, আমি নতুন এসেছি এই জেলায়। লাইব্রেরিটির কথা ভালো করে জানি না, তাদের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করলে সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করব।

প্রসঙ্গে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম বলেন, গ্রন্থকেন্দ্রে যুক্ত হবার থেকে বেশকিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।  এর মাঝে  দেশের শতবর্ষী লাইব্রেরি ও পাঠাগার নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেছি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এই বিষয়ে আলাপ করব। মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ সাড়া পেলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারব। 

এখানে রয়েছে মূল্যবান সাময়িকী, তালপাতায় লেখা পুঁথি, ছবি স্টার

উল্লেখ্য তালিম হোসেন একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, অনুবাদক ও সাহিত্য সম্পাদক। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুসারী। নজরুল চর্চা ও প্রচারে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নজরুল একাডেমি।তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হচ্ছে—দিশারী, শাহীন ও নূহের জাহাজ। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

Comments

The Daily Star  | English

Govt plans to include private sector in US tariff talks

Bangladesh is currently reviewing the proposals and will send a response within the next couple of days, Commerce Secretary Mahbubur Rahman told The Daily Star yesterday over the phone.

15h ago