কোন পথে পাকিস্তানের রাজনীতি

নির্বাচন বিলম্বিত হলে কিংবা সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে শাসনের কলকাঠি নাড়তে থাকলে আবারও মেয়াদের আগে শাসকের বিদায় নেওয়ার সেই ঘেরাটোপেই পড়ে থাকবে পাকিস্তানের রাজনীতি।
কোন পথে পাকিস্তানের রাজনীতি
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির ও ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত 

স্বাধীনতার পর ৭৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো শাসকই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের ঘেরাটোপেই আবর্তিত হয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতি। 

এর সবশেষ উদাহরণ গত বছরের এপ্রিলে তেহরিক-ই ইনসাফ দলটির নেতা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অপসারণ। অনাস্থা ভোটে অভিশংসিত হন ইমরান। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানের বিজয়ের নেপথ্যে ছিল সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ। তবে সময়ের সঙ্গে শীতল হয়ে উঠতে থাকে এ সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অপসারিত হবার পর কয়েকটি বিশাল জনসভা করে জনভিত্তির প্রমাণ রাখেন ইমরান। এ বছরের মে মাসের ৯ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তখন পুরো পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা সামরিক বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনে হামলা চালান, যা অতীতে কখনো দেখেনি পাকিস্তান। তবে ৩ মাস পর, আগস্টে আবারও ইমরান খান গ্রেপ্তার হলে সেরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। এর পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনীর অনমনীয় মনোভাব। 

বিবিসির বিশ্লেষক ক্যারোলাইন ডেভিস এর মতে, গত মে মাসের হামলার পর সেনাবাহিনী জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। গোটা দেশজুড়ে পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই -ইনসাফ)-এর কর্মী-সমর্থকদের ধরতে চালানো হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান। ফলে মে মাসের মতো করে প্রতিক্রিয়া দেখানো ইমরান সমর্থকদের দ্বারা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। 

ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্টের মেয়াদ অনুযায়ী অক্টোবরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ চাইছেন নির্বাচন বিলম্বিত হোক। বিপরীতে, ইমরান খান চাইছেন দ্রুত নির্বাচন আয়োজন। 

তবে তোশাখানায় জমা হওয়া রাষ্ট্রীয় উপহারের মূল্য পরিশোধ না করার অভিযোগে এ মাসে ইমরানকে গ্রেপ্তার করায় ৫ বছরের জন্য 'নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য' বিবেচিত হয়েছেন তিনি। ফলে আগামী নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ইমরানের অবর্তমানে তার রাজনৈতিক দল কতটা সাবলীলভাবে কার্যক্রম চালাতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। 

ইমরান গ্রেপ্তার হবার পর তার বাড়ির সামনে মুক্তির দাবিতে জড়ো হতে থাকা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১০০-এর কাছাকাছি নাগরিককে গ্রেপ্তারের কথা। শুধু রাস্তার আন্দোলন দমনই নয়, সেনাবাহিনী বৈঠক করেছে টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সঙ্গেও। ইমরান খান গ্রেপ্তার হবার পর সে বিষয়ক কোনো খবর, প্রতিবাদের কোনো সংবাদ টেলিভিশনেও তেমন আসছে না। চ্যানেলগুলো 'সেলফ সেন্সরশিপ'-এর চর্চা করছে বেশ ভালোভাবেই। 

ঘোলাটে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা। বন্যা পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত ছিল পাকিস্তান। ছিল ব্যাপক তারল্য সংকট। 

দ্য ডনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গত বছরের তুলনায় পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। প্রায় ৮ মাসব্যাপী আলোচনার পর গত ১২ জুলাই পাকিস্তানের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার (৩০০ কোটি ডলার) ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। এ জন্য পাকিস্তানকে করতে হয়েছে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, করের অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্তপূরণ। প্রথম দফায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে পাকিস্তান। পরবর্তী ৯ মাসের ভেতর বাকিটুকু পেয়ে যাবে। 

এ ছাড়া সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও তহবিল পেয়েছে পাকিস্তান। এতে খাদের একদম কিনারায় থাকা প্রায় দেউলিয়া হতে বসা অর্থনীতি হয়তো সাময়িকভাবে দিশা খুঁজে পাবে। 

এর ভেতর চলমান রয়েছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা। অতীতে মুসলিম লীগের নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল সামরিকতন্ত্র। তাই মুসলিম লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক খুব সহজ নয়। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পতনও হয়েছিল সামরিক বাহিনীর হাতে। ফলে পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) সামরিক বাহিনীর ওপর তেমন আস্থা রাখতে পারে না। 

তবে গত ৭৬ বছরের ইতিহাস বলে সামরিক আশীর্বাদ ছাড়া পাকিস্তানের কোনো শাসকেরই পক্ষে সম্ভব হয়নি ক্ষমতায় টিকে থাকা। ইমরান নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়। দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তরুণ ও নারী ভোটারদের ভেতর উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন রয়েছে তার। তবে ক্ষমতার প্রশ্নে জনগণের চেয়ে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর আস্থাভাজন হওয়াটিই বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে সব সময়। 

মে মাসে গ্রেপ্তার হবার পর ইমরান খান তার দলের ওপর হামলার জন্য দায়ী করেছিলেন সেনাপ্রধান আসিফ মুনীরকে। সে সময় পাকিস্তানের সংবাদপত্র 'ডন'-এর বরাতে জানা যায়, ইমরানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার 'ধ্বংস' করতে তার গ্রেপ্তারকে সমর্থন করেছেন আসিম মুনীর। 

সে সময় জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্সের গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছিলেন, ''পাকিস্তানের চলমান সংকট থেকে সেনাবাহিনী নিজেদের দূরে রাখছে। তিনি মনে করেন, 'সেনারা পাকিস্তানের ভেতর স্থিতিশীল পরিবেশ চায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।' 

তবে মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই প্রত্যেক শাসকের বিদায়, সেই স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আদৌ ভালো কি না সে প্রশ্ন রয়েই যায়। 

পাকিস্তানের রাজনীতিতে জনমতের প্রতিফলন না ঘটার ইতিহাস বহু পুরনো। ইমরান নিজে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে পাকিস্তান ভেঙে যাবার জন্য সামরিকতন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন। দ্য ডন পত্রিকায় এক কলামে সাংবাদিক ও বিশ্লেষক এজাজ আহমেদ চৌধুরী গত মে তে লেখেন, 'দেশ পর্যায়ক্রমে গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। জনপরিসরে সংঘাত হয়ে উঠেছে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। একে ঠেকাতে না পারলে দেশ ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।' 

১৯৭১ সালে জনরায় মেনে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফল হিসেবে যে দেশের একটি অংশই হারাতে হয়েছে তা মনে করিয়ে দিতেও ভোলেননি এজাজ আহমেদ চৌধুরী। 

সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান এখন কী করবে? সব কিছুর জন্য প্রাথমিক উপশম হতে পারে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। যদিও এত বছর ধরে চলে আসা সামরিকতন্ত্র তাদের স্বার্থের ওপরে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের রাজনীতিতে সামরিক অভিজাতবর্গের অংশগ্রহণ ও প্রভাব এখনো বিদ্যমান ও তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। ইমরান খানের অভিশংসনও পাকিস্তানের 'হাইব্রিড রেজিম' হওয়ার ব্যাপারটিই আমাদের কাছে পরিষ্কার করে। এমন অবস্থায় নির্বাচন বিলম্বিত হলে কিংবা সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে শাসনের কলকাঠি নাড়তে থাকলে আবারও মেয়াদের আগে শাসকের বিদায় নেওয়ার সেই ঘেরাটোপেই পড়ে থাকবে পাকিস্তানের রাজনীতি। আর এটি বাড়িয়ে তুলতে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরও সংকটের মুখে পড়তে পারে পাকিস্তান।

 

Comments