পেলোসি কি বোতল থেকে জ্বীন বের করে দিয়ে গেলেন

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের সেই ‘সোনালি আপেল’কে ঘিরে দেব-দেবীদের দ্বন্দ্ব দিন শেষে জনযুদ্ধের রূপ নিয়ে ধ্বংস করেছিল ট্রয় শহর। তেমনি চিত্র যেন দেখা যাচ্ছে স্বঘোষিত দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে ঘিরে।
তাইপে এসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যেন নতুন করে উসকে দিলেন প্রায় ৭০ বছরের পুরনো চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব।
তাইপে এসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যেন নতুন করে উসকে দিলেন প্রায় ৭০ বছরের পুরনো চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব।

প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের সেই 'সোনালি আপেল'কে ঘিরে দেব-দেবীদের দ্বন্দ্ব দিন শেষে জনযুদ্ধের রূপ নিয়ে ধ্বংস করেছিল ট্রয় শহর। তেমনি চিত্র যেন দেখা যাচ্ছে স্বঘোষিত দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে ঘিরে।

গত সোমবার ৪ দিনের এশিয়া সফর শুরু করে দ্বিতীয় দিনে তাইপে এসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যেন নতুন করে উসকে দিলেন প্রায় ৭০ বছরের পুরনো চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব।

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনকে মার্কিন নেতা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'এ সফর এই বার্তা দিচ্ছে যে, আমরা তাইওয়ানকে ত্যাগ করবো না।' সন্দেহ নেই, পেলোসির এমন আশ্বাসে বেজায় খুশি কট্টর চীনবিরোধী প্রেসিডেন্ট সাই।

১৯৫৪ সালে সই করা 'সিনো-আমেরিকান মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি'র মাধ্যমে আইনগতভাবে তাইওয়ানকে রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ওয়াশিংটন। চুক্তিটি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এর আগের বছরেই, মার্কিন কংগ্রেসে পাস হয় 'তাইওয়ান রিলেসনস অ্যাক্ট'।

বলা বাহুল্য, এসব আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র 'মিত্র' তাইওয়ানকে 'স্বাধীন-গণতান্ত্রিক দেশ' হিসেবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

২০২০ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট সাই দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলে বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের ক্রমাগত হুমকি 'বেইজিংপন্থি' নেতা হান কুও-ইউকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল।

তাইওয়ানকে ঘিরে চীন সরকার যতই 'আক্রমণাত্মক' হবে তাইওয়ানের জনগণ আরও বেশি 'বেইজিংবিরোধী' হয়ে উঠবেন।

প্রায় ২ বছর আগে নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট সাই বলেছিলেন, 'তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র যখনই হুমকির মুখে পড়বে দ্বীপবাসী তখনই জোরালোভাবে তাদের স্বাধিকারের ইচ্ছা প্রকাশ করবে।'

আজ বৃহস্পতিবার চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ট্যাবলয়েড পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস জানায়, মহাপ্রাচীরের দেশটি তাইওয়ান প্রণালীতে 'পুনঃএকত্রীকরণ অভিযান' (রিইউনিফিকেশন অপারেশন) শিরোনামে সামরিক মহড়া শুরু করেছে। এটি ৪ দিন চলবে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

চীনের সামরিক বিশেষজ্ঞ সং ঝংপিংয়ের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, 'ভবিষ্যতে সামরিক সংঘাত হলে চীনের করণীয় কী হবে তা এই মহড়ার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে।'

চীন যখন 'পুনঃএকত্রীকরণ অভিযান' চালাচ্ছে তখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১০ দেশের জোট আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা 'সংযমের' আহ্বান জানিয়েছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছেন, 'সামান্য ভুল বিশ্ব শক্তিগুলোকে বড় সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।'

চীন সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশী এসব দেশ থেকে ঠিক কতটুকু সমর্থন পাবে তা সময়ই বলবে।

যা ঘটতে পারে

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পরাশক্তি রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরু করলে ইউরোপ এক নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। সেসময় চীন 'প্রতিবেশী' তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়।

স্পষ্টতই, প্রায় ৫ মাস পর সেই আশঙ্কা আরও গভীর হয়েছে স্পিকার পেলোসির তাইপে সফরের মাধ্যমে।

জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার বিশ্লেষণে বলা হয়, পেলোসির তাইওয়ান সফর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

জিনপিং যখন পেলোসির সফর ঠেকাতে পারেননি তখন তিনি যে নিজের দেশে 'চরম চাপে' পড়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যে মার্কিন নেতাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মানুষ নন এখন তা প্রমাণ করতেই হবে।

আগামী নভেম্বরে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন হতে যাচ্ছে। প্রতি ১২ বছর পরপর এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এবারের সম্মেলনে জিনপিংয়ের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগেই হয়তো তিনি নিজেকে 'যোগ্যতম' ব্যক্তি হিসেবে জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন।

চীন নিজের শক্তিমত্তা প্রকাশের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে তাইওয়ানের চারপাশে নৌ ও বিমান বাহিনী নিয়ে মহড়া শুরু করেছে। পাশাপাশি তাইওয়ানের ওপর 'অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ' আরোপের পথেও হাঁটছে বেইজিং।

গতকাল বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পেলোসির সফরের কারণে চীন তাইওয়ানে প্রাকৃতিক বালু রপ্তানি এবং তাইওয়ান থেকে ফল ও মাছ আমদানি বন্ধ করেছে।

এই বিধিনিষেধ 'প্রতীকী' হিসেবে উল্লেখ করে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, উত্তেজনা আরও তীব্র হলে তা বহু বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক শিল্প গবেষণা সংস্থা কাপরনএশিয়ার পরিচালক জেনন কাপরনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের ভ্যালু চেইনের 'অবিচ্ছেদ্য অংশ'।

তিনি মনে করেন, 'তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর খুব বেশি চাপ দেওয়া চীনের জন্য কঠিন হবে'।

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়, সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বে তাইওয়ানের অবদান ৬৪ শতাংশ। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমানে এসব চিপ ব্যবহার করা হয়। সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর চীন কোনো চাপ তৈরি করলে তা 'নিজের পায়ে কুড়াল' মারার মতোই হতে পারে বলে বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয়।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের 'ডঙ্কা'

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের' দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। শীতলযুদ্ধের পর বিশ্বকে আবারো সুস্পষ্টভাবে ২ ভাগে বিভক্ত দেখা গেল।

তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের দ্বন্দ্বে সেই বৈশ্বিক বিভক্তিরেখা যেন আরও প্রসারিত হতে যাচ্ছে। ন্যাটোর সম্প্রসারণনীতিকে যারা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ বলে মনে করছেন তারাই এবার পেলোসির 'উসকানিমূলক' সফরকে 'তাইওয়ান যুদ্ধের কারণ' হিসেবে দেখতে পারেন।

চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা নিয়ে ইতোমধ্যে সেই 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন বিশ্লেষকরা।

গত মঙ্গলবার আল জাজিরার এক বিশ্লেষণের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—'ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনবে না'। এতে বলা হয়, হাউস স্পিকারের উসকানিমূলক সফর সম্ভবত 'দ্বীপরাষ্ট্র'টিকে দীর্ঘদিনের জন্য বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে।

এখন সবকিছু বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে— পেলোসি তাইপে এসে বোতল থেকে জ্বীন বের করে দিয়ে গেলেন না তো?

Comments