ভারতে নারী পাচার: সীমান্তে পাচারকারীদের ‘ধুরচক্র’

পাচারকারীরা মাতিলা গ্রামকে মানবপাচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
ভারতে নারী পাচার: সীমান্তে পাচারকারীদের ‘ধুরচক্র’
প্রতীকী ছবি

বিদেশে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি বছর হাজারো মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় ভারতের মুম্বাই ও পুনের মতো শহরে। দ্য ডেইলি স্টারের তদন্তে উভয় সীমান্তের দালাল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতাসহ অন্ধকার এই জগতের নানা বিষয় উঠে এসেছে। চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব এটি।

সীমান্ত সংলগ্ন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে সহায়তা করে একটি চক্র। স্থানীয়ভাবে তাদের 'ধুর' বলে।

মহেশপুরের অন্তত এক ডজন পাচারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে ডেইলি স্টার

এই পাচারকারীরা মাতিলা গ্রামকে মানবপাচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। তারা রাজকোল, পুলিয়া, রাউংঘাট ও ভোভোদাশপুরের মতো সীমান্ত ব্যবহার করে মানবপাচার করছে। পাচারকারীরা জানান, প্রতিদিন ২০ থেকে ৪০ জন নারী ও পুরুষ পাচার হয়৷

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ধুরদের এক নেতা জানান, তাদের কার্যক্রম এখন কুলে-পাচপিটোলা ও আন্দুলি সীমান্ত পয়েন্টেই চলে। আরেকটি পয়েন্ট দৌলতপুরও অরক্ষিত আছে।

মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর সীমান্ত পয়েন্টে কথা বলছিলেন ওই ব্যক্তি।

ধুররা অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে দিতে জনপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নেন। এই দর ওঠানামা করে সীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর।

অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে চাওয়া ব্যক্তিদের অস্থায়ীভাবে সীমান্ত এলাকার কোনো বাড়িতে এক বা দুদিনের জন্য রাখা হয়। তাদের ততক্ষণই রাখা হয়, যতক্ষণ না নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করার ব্যাপারে সবুজ সংকেত পাওয়া যায়। মধ্যরাত বা রাতের প্রথম প্রহরে নীরবে সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে এই অচেনা ব্যক্তিদের সীমান্তের বাড়িগুলোতে কীভাবে লুকিয়ে রাখতে পারেন? জানতে চাইলে ওই ধুর নেতা জানান, যখনই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা কোনো বাসিন্দা তাদের সম্পর্কে জানতে চান, তখন তারা তাদেরকে আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন যে তারা বেড়াতে এসেছে। সীমান্তের এসব বাড়িতে আশ্রয় নিতে এবং পরবর্তী যাত্রা শুরু করতে প্রতি রাতের জন্য দুই হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই টাকার মধ্যে তাদেরকে খাবারও দেওয়া হয়।

এই ব্যবসা বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ধুর নেতা বলেন, 'সারা দিন মজুরি করলে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা রোজগার করতে পারি। আর এই কাজে এক রাতে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় হয়।'

কেউ তাদের এই কাজের বিরোধিতা করলে তাকে মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে কেউই তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সাহস করেন না। যারা এসব কাজের বিরোধিতা করেন, তাদেরকে আইনি ফাঁদে ফেলে দেওয়া হয়। তাদের বাড়ির কাছে ফেনসিডিল বোতল রেখে দেওয়া হয় এবং পুলিশকে সেই খবর পৌঁছে দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করানো হয়।

ওই ধুর নেতা আরও জানান, তারা ওই এলাকায় কর্তব্যরত পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে আয়ের একটি অংশ পৌঁছে দেন। এমনকি যখন ধুরদের গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তারা একদিনের মধ্যেই অলৌকিকভাবে জামিন পেয়ে যান। এর জন্য একদল আইনজীবী তাদের সহায়তা করেন।

যখন তারা বিজিবিকে ম্যানেজ করতে পারে না, তখন ভিন্ন পরিকল্পনার আশ্রয় নেয়। তারা বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিলের বস্তা ফেলে আসে এবং তারপর সীমান্তের কাছে মাদকের চালান সম্পর্কে বিজিবি পোস্টে খবর পৌঁছে দেয়। একটি বিজিবি ইউনিটের সাফল্যের বড় অংশ নির্ভর করে তারা কী পরিমাণ মাদক উদ্ধার করতে পেরেছে তার ওপর। এই সুযোগটাই নেয় ধুররা। বিজিবি যখন কথিত সেই মাদকদ্রব্য উদ্ধারে বের হয়ে যায়, তখন ধুররা গোপনে মানবপাচার করে।

মাতিলা গ্রামের অন্যতম পাচারকারী মো. ওয়াকিমাইল (৪৭)। আরেকজন হচ্ছেন জিয়া। তিনি বিজিবির লাইনম্যান হিসেবেও কাজ করেন। অবৈধ মানবপাচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য প্রতিদিনের ঘুষের টাকাও সংগ্রহ করেন জিয়া।

মাতিলা গ্রামের জিরো লাইনে ডেইলি স্টারকে এক ধুর বলেন, পাচার করা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য বিজিবি তাদের লাইনম্যানের মাধ্যমে এক হাজার টাকা করে নেয়।

তবে বিজিবি মহেশপুর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ পারভেজ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা সব ধরনের অবৈধ কাজ বন্ধ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন এবং মানবপাচারের প্রবণতা কমছে।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'মানুষ তিনটি কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন—চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও পাচারের শিকার হয়ে। পাচারের শিকার যারা হচ্ছেন, তাদেরকে শনাক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।'

উভয় সীমান্ত মিলিয়ে অন্তত আটটি সূত্র জানায়, সীমান্ত পার করে দিতে সব মিলিয়ে কত টাকা নেওয়া হবে তা নির্দিষ্ট না। সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এই দর ওঠানামা করে সাত হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। কখনো কখনো এই দর ১৬ হাজার টাকাতেও পৌঁছায়।

মাতিলা গ্রামের একটি ছোট্ট খাল দুই দেশকে বিভক্ত করেছে। শুষ্ক মৌসুমে এই খালের পানি হাঁটু পর্যন্ত থাকে। বর্ষায় এই খালের পানি থাকে অনেক বেশি। বর্ষার সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে প্রায়শই নগ্ন অবস্থায় খাল পাড়ি দিতে বাধ্য করা হয়।

এক ধুর জানান, পাচার করা কোনো নারী বা তরুণী সুন্দর হলে তাদেরকে প্রায়শই সীমান্তে যৌন নির্যাতন করা হয়। সীমান্ত পার করার আগে এই নারী বা তরুণীদের এক রাত তারা বন্দি করে রাখে।

এমনকি স্থানীয় থানার পুলিশও তাদের ভাগ দাবি করে এই ধুরদের কাছ থেকে। নিজেদের লাইনম্যানের মাধ্যমে তারা পাচার করা ব্যক্তিপ্রতি ৫০০ টাকা করে নেয়। ধুররা কোনো ধরনের সমস্যা এড়িয়ে চলতে এসব দাবি পূরণ করে।

মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শামীম উদ্দিন এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তারা এসব পাচারকারীদের কাছ থেকে কোনো টাকা আদায় করেন না।

তিনি বলেন, 'কোনো অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেই। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি যে চিকিত্সার জন্য তারা পাসপোর্ট ছাড়াই সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে। অনেক সময় পাচারের শিকার ব্যক্তিদেরও পাই এবং এ ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।'

খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, সীমান্ত এলাকার থানাগুলো পাচারের বিষয়ে সব জানে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিন্তু এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কারণ আমরা এর থেকে সুবিধা পাই। অনেক সময় পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা হলেও শক্তিশালী প্রমাণের অভাবে তারা দুয়েকদিনের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যায়।'

এর আগে বাংলাদেশ থেকে মুম্বাইয়ে নারী পাচার করতে মূলত পশ্চিমবঙ্গকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেত। কিন্তু সম্প্রতি তারা সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে মুম্বাই যেতে শুরু করেছে।

স্থানীয় পাচারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও ডেইলি স্টারের তদন্তে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এই পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত।

বেনাপোল এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সুলতান আহমেদ বাবুকে এমনই একজন নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন স্থানীয়রা। বেনাপোলের এক নম্বর ওয়ার্ডের সাদিপুর গ্রাম পাচারকারীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা টাকার বিনিময়ে পাচার করতে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের তাদের বাড়িতে রাখেন বলে জানা গেছে।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বাবু স্বীকার করেছেন যে তিনি মানবপাচার করেন।

তিনি বলেন, 'আমরা মানবিক কারণে তাদের সাহায্য করি। আমরা তাদের সরাসরি মোটরসাইকেলে করে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে পাঠাই। এটা বেনাপোল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে।'

এর জন্য কত টাকা নেওয়া হয় জানতে চাইলে বাবু বলেন, 'আমি ঠিক জানি না। তবে তারা পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়। মোটরসাইকেলচালকরা দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়।'

বাবু আরও বলেন, 'কোনো পুরুষ তাদের সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। এ জন্য আমরা বুঝতে পারি না যে তাদের পাচার করা হচ্ছে কি না।'

বাবু এটাও স্বীকার করেন যে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য আসা ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে দরিদ্র গ্রামবাসীদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেক্ষেত্রে তারা প্রতি রাতের জন্য ৫০০ টাকা করে ভাড়া দেয়।

সীমান্তের ওপারে ভারতের হরিদাসপুর ও জুয়াপুর গ্রামেও একই ধরনের আবাসন সুবিধা রয়েছে বলে জানান বাবু।

Comments