নজরদারির অভাব ও অব্যবস্থাপনায় অনিরাপদ টাঙ্গাইল মহাসড়ক

নিয়মিত নজরদারি ও প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়কে বিশেষ করে রাতের পরিবহনে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে।

নিয়মিত নজরদারি ও প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়কে বিশেষ করে রাতের পরিবহনে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে।

গত ৩ আগস্ট মহাসড়কের টাঙ্গাইল অংশে একটি চলন্ত বাসে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর মহাসড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

সে রাতে যাত্রীবাহী বাসটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ডাকাতদল ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘুরে যাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্র লুটের পাশাপাশি সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে পালিয়ে যায়। 

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহসড়কের নাটিয়াপাড়াতে রাত ১টায় বাসটিতে ডাকাতি শুরু করে ১০ জনের ডাকাতদল। পরে গোরাই থেকে গাড়িটি ঘুরিয়ে একই মহাসড়ক ব্যবহার করে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়ে গিয়ে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় যাত্রীসহ গাড়িটি ফেলে যায় তারা। 

মহাসড়ক দুটিতে ডাকাতি করা বাস নিয়ে কমপক্ষে ৯০ কিলোমিটার রাস্তায় ডাকাতদের হাতে যাত্রী নির্যাতন, হৈ-হল্লা, কান্নাকাটি, চিৎকার, চেচামেচি কিছুই টের পায়নি মহাসড়কে দায়িত্ব পালনকারী গোড়াই এবং এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ।

এর আগে টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতের কবলে পড়েন এক চিকিৎসক। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মধুপুরে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এক কলেজ ছাত্রীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে বাসচালক, সুপারভাইজার ও হেলপার।  

মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গোড়াই হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোল্লা টুটুল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর ব্রিজ থেকে করটিয়া পর্যন্ত গোড়াই হাইওয়ে পুলিশের কয়েকটি পেট্রোল পার্টি টহল দেয়।

তিনি বলেন, 'সদা ব্যস্ত এই মহাসড়কে দিনরাত প্রায় ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এত বিপুল সংখক যানবাহনের মধ্যে চলন্ত যানবাহনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বোঝা কঠিন।'

আগে মহাসড়কের মির্জাপুর হাটুভাংগা এলাকায় নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশী এবং ভিডিও ধারণ করা হলেও এর ফলে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তা বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, 'অপরাধ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কটি অবিলম্বে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা প্রয়োজন। তাতে করে মহাসড়কে যান চালচলে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পেলে- কেউ গাছের গুড়ি ফেলে বা অন্য কোনো উপায়ে মহাসড়কে কোনো ব্যারিকেড দিলে বা অবরোধ করলে, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে, যানজট সৃষ্টি হলে হাইওয়েতে কর্তব্যরত পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।'

'এছাড়া যানবাহনে সিসি ক্যামেরা লাগানো যেতে পারে যাতে কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়। হাইওয়ে পুলিশকে আরও আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করাও এখন সময়ের দাবি', বলেন তিনি।
জানতে চাইলে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনিসুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের টহল দলের পক্ষে ব্যস্ত মহাসড়কে চলাচলকারী কয়েক হাজার যানবাহনের কোনটির ভেতরে কি ঘটছে তা বোঝা সম্ভব নয়। বিশেষ করে রাতে যখন যাত্রীবাহী বাসগুলো জানালায় পর্দা লাগিয়ে এবং ভেতরের বাতি নিভিয়ে চলাচল করে।'

দুর পাল্লার পরিবহনে রাস্তা থেকে যাত্রী উঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কাউন্টার ছাড়া রাতের কোচে কোনো অবস্থাতেই রাস্তা থেকে যাত্রী উঠানো উচিত নয় এবং কাউন্টার থেকে যাত্রী উঠানোর সময়ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে তাদের ফুটেজ সংগ্রহ করে রাখা দরকার।'

হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (গাজীপুর) নাজমুস সাকিব বলেন, 'মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের নিয়মিত টহল অব্যাহত রয়েছে। সিনিয়র অফিসাররা নিয়মিত ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।'

সব গণপরিবহনেই চালকের কাছাকাছি সিসি ক্যামেরা সংযোজন করা উচিত বলে জানান তিনি।

'এতে করে যাত্রী উঠানো ও নামানোর সময় এবং পুরো গাড়ির যাত্রীদের ফুটেজে দেখা যায়,' তিনি বলেন।

'এছাড়া গাড়িতে জিপিএস সুবিধার পাশাপাশি চালকের কাছাকাছি গোপন স্থানে এমন ডিভাইস সংযোজন করা যেতে পারে যাতে কোনো অপরাধের লক্ষণ দেখলেই চালক বোতামে চাপ দিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিবহন ও যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এসব বিষয়ে আমরা বহুদিন ধরেই পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছি,' বলেন তিনি।

মহাসড়কে যানবাহন এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের যে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পূর্ণ সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলা মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম তুষার।

তিনি বলেন, 'কয়েকদিন আগে মহাসড়কে একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জেলার একজন পরিবহন শ্রমিক জড়িত থাকায় আমরা ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। জেলার কোনো পরিবহন শ্রমিকের এই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক এবং উদ্বেগের বিষয়। এসব ঠেকাতে যথাযথ বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাইসেন্সধারী এবং শ্রমিক ইউনিয়নে তালিকাভূক্তদের নিয়োগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিক ইউনিয়নকে এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।'    

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের টাঙ্গাইল জেলা শাখার সহ-সভাপতি সাজ্জাদ খোশনবিশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু অপরাধ ঠেকাতেই নয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা এড়াতেও যানবাহনগুলোতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো সংযোজন করা প্রয়োজন।'

'একজন পরিবহন মালিক যদি ৬০ লাখ থেকে এক/দুই কোটি টাকা খরচ করে রাস্তায় একটি বাস নামাতে পারেন তবে এসব প্রযুক্তি সংযোজন করতে পারবেন না কেন? কতই আর খরচ হবে? তবে এজন্য সরকারি নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে,' বলেন তিনি।

এছাড়াও পরিবহন শ্রমিকরা যাতে কোনো প্রকার যাত্রী হয়রানী বা অপরাধ করতে না পারে সেজন্য রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মতো যাত্রী কর্তৃক রেটিং এর ব্যবস্থার কথা জানান তিনি।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর মহাসড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবছি। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অচিরেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে এবং নতুন পরিকল্পনা সংযোজন করা হবে।'

Comments