হাঁস পালা যাদের নেশা

আক্কাস মিয়া চলতি মৌসুমে কিনেছিলেন ১ হাজার ৪০০ হাঁস এবং জহিরুল কিনেছিলেন ৬০০টি হাঁস। ছবি: স্টার

কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরের পূর্ব গ্রাম বেড়িবাঁধে ৮টি পরিবার হাঁস লালন-পালন করে। তবে তাদের মধ্যে এক পরিবারের দুই ভাইয়ের নেশাই হাঁস পালা। গত প্রায় ২৫ বছর ধরে তারা হাঁস পালেন এবং হাঁস ও ডিমের ব্যবসা করেন। বছরের প্রায় ৯ মাস সময় ব্যয় করেন হাঁসের পেছনে। হাঁস পালনের নেশায় নিকলী হাওরে জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে ২ ভাইয়ের।

এই দুই ভাই মো. আক্কাস মিয়া (৪৮) ও ছোট ভাই জহিরুল ইসলামের (৪০) বাড়ি নিকলী উপজেলার টিকলহাটি গ্রামে। গত সপ্তাহে নিকলী হাওরের পূর্ব গ্রাম বেড়িবাঁধে তাদের সঙ্গে দেখা হয়।

আক্কাস মিয়া চলতি মৌসুমে কিনেছিলেন ১ হাজার ৪০০ হাঁস। বেশ কিছু হাঁস মারা যাওয়ার পর এখন আছে ৫০০টি। জহিরুল কিনেছিলেন ৬০০ হাঁস। তার আছে এখন ৩৭০টি হাঁস।

ছবি: স্টার

তারা জানান, এ বছরের বন্যায় পানি বেড়ে যাওয়ায় এবং দূষিত পানির কারণে অনেকগুলো হাঁস মারা গেছে। হাঁস মারা যাওয়ায় তাদের এ বছর লোকসানে পড়তে হচ্ছে।

আক্কাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ছোটবেলা থেকে হাঁস পালি। ৬ মাস বয়সী বাচ্চা কিনি। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি হাঁস কেনার ১৫ দিনের মধ্যে সেগুলো ডিম দেওয়া শুরু করে। গড়ে প্রতিটি হাঁসের দাম পড়ে ৪০০ টাকা।'

তিনি জানান, প্রথম ৩ মাস ৯০ শতাংশ হাঁসই ডিম দেয়। তারপর ডিম দেওয়ার পরিমাণ কমে যায়। ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে তারা হাঁসগুলো বিক্রি করে দেন।

হাওর বা জলাশয়ে পানি থাকলে হাঁসকে খাওয়াতে সুবিধা হয় বলে জানান তারা। যখন যেখানে পানি থাকে হাঁস নিয়ে এই ২ ভাই সেখানে চলে যান।

পানি কমে এলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান হাঁস নিয়ে। যেসব জমিতে ধান কাটা শেষ হয়েছে, সেখানে হাঁসকে খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে সরাইলে গিয়ে এক মাস থাকেন। সেখান থেকে যান আশুগঞ্জ।

ছবি: স্টার

আশুগঞ্জে এক-দেড় মাস থাকার পর চলে যান নরসিংদীর মনোহরদী। সেখানে আবার এক-দেড় মাস থাকার পর খাবার ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে যান কিশোরগঞ্জের নিকলীতে।

এসব স্থানে তারা ট্রলার বা মুরগি পরিবহনের পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে হাঁস নিয়ে যান বলে জানান।

পরিবহনে বড় ভাই আক্কাসের খরচ হয় ৯০ হাজার টাকা, জহিরুলের খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা।

তারা জানান, হাঁসের প্রধান খাবার শামুক। ৩৭০টি হাঁসকে প্রতিদিন খাওয়াতে তার ৬০০ টাকার শামুক কিনতে হয়। আরও ৬০০ টাকার ধানের কুঁড়া কিনতে হয়। পোল্ট্রি ফিড কিনতে হয় ২০০ টাকার। প্রতিদিন মোট ১ হাজার ৪০০ টাকার খাবার দিতে হয় হাঁসকে।

তবে হাওরে বা জলাশয়ে হাঁসের জন্য প্রাকৃতিক খাবার পাওয়া যায় এবং খাবারের পেছনে প্রতিদিনের ব্যয় কমে আসে বলে জানান তারা। 

জহিরুল ডেইলি স্টারকে জানান, গত বছর ৫০০ হাঁস কিনে শেষ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছিল তার। তবে এ বছর তার ২ লাখ টাকা লোকসান হবে বলে ধারণা করছেন।

৩৭০টি হাঁসের মধ্যে এখন ৫০টি হাঁস ডিম দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

আক্কাস গত বছর ৬০০ হাঁস কিনে ২ লাখ টাকা লাভ করেছিলেন। এ বছর ১ হাজার ৪০০ হাঁস কিনেছিলেন তিনি। এ বছর অন্তত ৬ লাখ টাকা ক্ষতি হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।

দিনের ২৪ ঘণ্টাই হাঁসের পেছনে সময় ও শ্রম দিতে হয় বলে জানান তারা।

ভোর ৬টার দিকে হাঁসগুলোকে পানিতে নিয়ে যান। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পানিতে থাকার পর হাঁসগুলোকে নিয়ে তিনি বেড়িবাঁধের ওপর আসেন। সেখানে হাঁস রাখার জন্য জায়গা ভাড়া নিয়ে ছোট ঘরও বানিয়েছেন তিনি।

আক্কাস ও জহিরুল জানান, হাঁসগুলোকে জাল দিয়ে নিরাপদে রাখতে হয়। নিজের হাঁসগুলোকে আলাদা করে রাখার জন্য রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। হাঁসের খাবার সংগ্রহ করতে হয়। খাবার ঠিকমতো খাচ্ছে কি না, সব হাঁস ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হয়। হাঁস অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হয়। 

বর্তমানে আক্কাসের ৯০টি হাঁস ডিম দিচ্ছে। অথচ খাবারের পেছনে ২ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে প্রতিদিন। ৯০টি ডিম ১২ টাকা দরে বিক্রি করে আয় করেন প্রায় ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন তার প্রায় ১ হাজার টাকা ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'প্রথম ৩ মাস তো দ্বিগুণ লাভ করেছি। তখন যদিও প্রতিটি ডিমের দাম ছিল ৯ টাকা।'  

কিন্তু হাঁস পালার নেশায় বর্তমানে তিনি লোকসান করেও হাঁসগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

হাঁসের বাচ্চাগুলো তারা সিলেট থেকে কেনেন বলে জানান। ৬ মাস বয়সী প্রতিটি হাঁসের কেনার খরচ ৪০০ টাকা। আর বিক্রির সময় দাম পান ৩৫০ টাকা।

জমি বিক্রি করে হলেও প্রতিবছর হাঁস কেনেন এই দুই ভাই। এক একর জমি বিক্রি করেন ২ লাখ টাকায়।

মো. আক্কাস মিয়ার ২ মেয়ে ও ১ ছেলে এবং জহিরুলের ১ মেয়ে ও ১ ছেলে। সন্তানরা কেউ অবশ্য হাঁস পালনের সঙ্গে জড়িত না বলে জানান আক্কাস ও জহিরুল।

হাওরে আরও অনেকে হাঁস পাললেও, সবার কাছে এটা এমন নেশা নয়। অনেকেই হাঁস কেনেন, ডিম বিক্রি করেন, ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে হাঁস বিক্রি করে দেন।

Comments

The Daily Star  | English

Seven killed in Mymensingh road crash

At least seven people were killed and several others injured in a head-on collision between a bus and a human haulier in Mymensingh’s Phulpur upazila last night

1d ago