ঢাকায় ইয়াবা সরবরাহ বেড়েছে, ৩ মাসে জব্দ ১ কোটি ২০ লাখ

ডিএমপির ডেটাবেজ অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে মোট ৩ হাজার ৬৭৫টি মাদক মামলা হয়েছে এবং প্রায় ৫ হাজার ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফাইল ছবি

গত ১১ এপ্রিল রাত ১০টা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের দোকানগুলোতে ছিল কেনাকাটার ব্যস্ততা।

ক্রেতা সেজে সেখানে ছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক। ৩-৪ মিনিটের মধ্যে একটি গলির ভেতর থেকে একটি আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী ক্ষীণকায় এক তরুণ এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'মামা আপনার কয়টা লাগবে?'

তিনি ইয়াবা বিক্রির কথা বলছিলেন।

২ পিস বড় সাইজের ইয়াবার দাম জানতে চাইলে তিনি ৪০০ টাকা দাবি করেন।

একটু দর কষাকষির পর তিনি আড়াইশ টাকায় ২ পিস ইয়াবা দিতে রাজি হন এবং জানান, এটাই তার শেষ অফার।

সঙ্গত কারণেই এই প্রতিবেদক তাকে জানান যে, তিনি বেশি দাম চাচ্ছেন।

গত সপ্তাহে রাজধানীর ৫টি মাদক স্পট পরিদর্শন করে জানা গেছে, ঢাকায় ইয়াবা সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।

৫টি স্পটের মধ্যে রয়েছে—মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রেললাইন এলাকা, দক্ষিণ বেগুনবাড়ির এফডিসি গেট এলাকা, মিরপুর-১ এর গুদারাঘাট ও পল্লবীর সেকশন-১২ এর সিরামিক গেট এলাকা।

সরেজমিনে গিয়ে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক অন্তত ৩ জন নেতা, ২ জন মাদক চোরাকারবারি ও ২ জন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন। তারা প্রত্যেকেই সম্প্রতি ইয়াবা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বলছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদকের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি ইয়াবা সরবরাহ বেড়ে গেছে ও দাম কমে গেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

গত মাসে জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায়, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়াজুড়ে আইন প্রয়োগকারীরা ২০২১ সালে প্রায় ১৭২ টন মেথামফেটামিন জব্দ করেছে, যা গত এক দশকের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ইয়াবার দাম বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

জাতিসংঘ বলছে, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারজুড়ে বিদ্রোহের মুখে জান্তা সরকার বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বড় আকারের মাদক উত্পাদনে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এর মধ্যে রয়েছে শান রাজ্য, যেটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেথামফিটামিনের প্রাথমিক উৎস। মেথামফিটামিন ইয়াবার একটি উপাদান।

বাংলাদেশে সম্প্রতি ইয়াবার দাম কমে যাওয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদনগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গত সোমবার রাতে কাওরানবাজারের রেললাইন এলাকায় গিয়ে একজন ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় ডেইলি স্টারের।

তিনি বলেন, 'আমি ২০১২ সাল থেকে ইয়াবা সেবন করছি। প্রথমে দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখন ১৫০ টাকায় কিনতে পারছি। সম্প্রতি দাম অনেক কমে গেছে।'

ইয়াবা সরবরাহ বৃদ্ধি ও দাম কমার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার।

হুমায়ুন কবির গত ২ বছর ধরে ইয়াবা নিয়ে গবেষণা করছেন। বিভিন্ন পুনর্বাসন কেন্দ্রের ১২০ জন মাদকাসক্ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ১৮০ জন কর্মকর্তা এবং কক্সবাজারের কয়েক ডজন ইয়াবা চোরাকারবারির সহায়তায় তিনি তার গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, মূলত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর এবং ইয়াবা উৎপাদনে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করার পর ইয়াবা সরবরাহ বাড়তে শুরু করে।'

তার গবেষণায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াবার উৎপাদন খরচ অর্ধেক হয়ে গেছে। মাত্র ২ বছর আগে, এক টুকরো পিস উৎপাদন খরচ ছিল ১ হাজার মিয়ানমার কিয়াট, যা ৫০ টাকার সমান। বর্তমানে তা ৫০০ মিয়ানমার কিয়াটের কম।

'রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন এক পিস ইয়াবা ২৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে', বলেন তিনি।

মাদকাসক্ত ও চোরাকারবারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে ২ মাসের মাথায় ইয়াবার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ছোট আকারের ইয়াবার খুচরা দাম এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকা, যা ২ মাস আগেও ১২০ টাকা ছিল।

জানতে চাইলে জেনেভা ক্যাম্পের এক মাদক চোরাকারবারি বলেন, 'ঢাকায় প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা আসায় দাম কমে গেছে।'

আরেক মাদক চোরাকারবারি বলেন, 'ইয়াবা এখন অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে এবং গ্রাহকরা হোম ডেলিভারি পাচ্ছেন। মাদক চোরাকারবারিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে হোম ডেলিভারির জন্য নারীদের পাঠাচ্ছে।'

ইয়াবা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইয়াবা জব্দের পরিমাণও ৩ গুণ বেড়েছে। ১ বছর আগে আমরা মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার বড়ি জব্দ করতাম। কিন্তু এখন প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বড়ি জব্দ হচ্ছে।'

'আমরা সতর্কতা বাড়িয়েছি। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। ফলে আরও বেশি চালান শনাক্ত করা যাচ্ছে', বলেন তিনি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট চোরাচালানকৃত মাদকদ্রব্যের ৮ থেকে ১০ শতাংশই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বাকি প্রায় ৯০ শতাংশ বেচাকেনা হয়। তাই যখন চোরাচালান বেড়ে যায়, তখন জব্দ হওয়া মাদকের পরিমাণও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের ২০২২ সালের বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, সব সংস্থা মিলে গত ৫ বছরে প্রায় ২১ কোটি ৬৬ লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে।

এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ, ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ, ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ এবং ২০২২ সালে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ইয়াবা জব্দ করা হয়েছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডেটাবেজ অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে মোট ৩ হাজার ৬৭৫টি মাদক মামলা হয়েছে এবং প্রায় ৫ হাজার ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ডিএমপির তথ্যমতে, এই সময়ের মধ্যে পুলিশ ঢাকা থেকে অন্যান্য মাদকসহ ১ কোটি ২০ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়াবা চোরাকারবারের বিষয়ে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতি থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ইয়াবা ঢোকে বাংলাদেশে, যার আর্থিকমূল্য আনুমানিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় সাড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ইয়াবায় আসক্ত।

কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবার সিংহভাগ চালান টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। দেশে প্রবেশের পর ইয়াবার চালান প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মজুত করা হয়। সেখান থেকে এগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, মাদক পাচারকারীরা ইয়াবা পাচারের জন্য কৌশলী উপায় অবলম্বন করছে। সন্দেহ ও গ্রেপ্তার এড়াতে মূলত দরিদ্র নারী ও শিশুদের তারা ব্যবহার করে থাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-৮) সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন্স অ্যান্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।'

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ছাড়া শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় মাদক সরবরাহ বন্ধ হবে না। সামান্য বিনিয়োগ করে এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। সুতরাং মানুষ এজন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে।'

তিনি মাদকের সরবরাহ কমানোর জন্য মাদক চক্রের নেতাদের গ্রেপ্তারের ওপর জোর দেন। তবে এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

শহীদুল হক বলেন, 'পুরো ব্যবসা একটি কাট-আউট কৌশলে পরিচালিত হয়। এটি কিছু সংকেত বা কোড শব্দ ব্যবহার করে চলে। পুরো র‌্যাকেট সম্পর্কে কোনো বাহক বা চোরাকারবারির কোনো ধারণা নেই। সেই কারণে মাস্টারমাইন্ড সবসময় দৃশ্যের বাইরে থাকে এবং শুধু বাহকদের গ্রেপ্তার করা হয়।'

এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, 'ইয়াবা সরবরাহের বৃদ্ধি সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।'

পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, জানতে চাইলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। এ ছাড়া, যখনই আমরা প্রয়োজন মনে করি, তখনই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করি।'

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি-২) কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সীমান্তে সুরক্ষা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযান পরিচালনা করছে। আমরা গত মাসে প্রায় ৬ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. তাওহিদুল হক বলেন, 'ইয়াবার দাম কমে যাওয়ায় মাদক এখন আরও সহজলভ্য হবে এবং সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়বে।'

'তরুণ প্রজন্ম, যারা আসলে আমাদের কর্মশক্তি, তারা আরও আসক্ত হবে। ফলে ধীরে ধীরে তারা কর্মশক্তি হারাবে ও নির্ভরশীল হয়ে উঠবে এবং এক সময়ে গিয়ে তারা পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।'

ঢাবির এই শিক্ষকের পরামর্শ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শুধু কথায় নয়, বাস্তবে কাজ করতে হবে। এই হুমকি ঠেকাতে এর পেছনের মূলহোতাকে তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

এ বিষয়ে ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) তানভীর মমতাজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সংকটের সমাধান খুঁজতে ডিএনসি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে।'

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments