রূপগঞ্জে স্টিল মিলে বিস্ফোরণ

ছাড়পত্র-নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই চলছিল লোহা গলানোর কাজ

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩ শ্রমিক মারা গেছেন।
ছাড়পত্র-নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই চলছিল লোহা গলানোর কাজ
রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড। ছবি: স্টার

ছাড়পত্র ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই গত ৬ মাস ধরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড (আরআইসিএল) নামের কারখানাটিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল বলে জানিয়েছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় অবস্থিত কারখানাটিতে লোহা গলানোর কাজ করার সময় চুল্লিতে বিস্ফোরণে ৭ শ্রমিক দগ্ধ হন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩ শ্রমিক মারা গেছেন। বাকিরা রাজধানীর শেখ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. আইউব হোসেন।

বিস্ফোরণের পর বৃহস্পতি ও শুক্রবার ২ দফায় কারখানাটি পরিদর্শন করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

অধিদপ্তরের পরিদর্শক মেহেদী হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো ছাড়পত্র দেখাতে পারেননি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় ছাড়পত্র পায়নি প্রতিষ্ঠানটি।'

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে আরআইসিএল কারখানা কর্তৃপক্ষ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ জন পরিদর্শক কারখানাটি পরিদর্শন করে কারখানার শ্রেণি ও কাজের ধরন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় আগে তা নিশ্চিত করার পর ছাড়পত্র প্রদানের কথা জানান। গত মার্চেও সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শন করেন তারা। এ সময় কারখানার মেশিন লে-আউট, শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা পোশাক যথাযথ না হওয়ায় তারা প্রথমে মৌখিক ও পরে লিখিতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছিলেন। যদিও শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ লোহা গলানোর কারখানাটিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে কারখানাটির তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ৬ মাস ধরে কারখানাটিতে লোহা গলানোর কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে কালকারখানা পরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, 'কারখানা চালু করার অন্তত ১৫ দিন আগে আমাদের অবহিত করতে হয়। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ তা করেননি। সেফটি ব্যবস্থা কেমন আছে, কারখানার অবকাঠামো, লে-আউট ঠিকমতো আছে কি না এসব বিষয়ের ওপর ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। তারা ছাড়পত্র ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছিল। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। পুরোপুরি তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

ছাড়পত্র ছাড়া কার্যক্রম চালানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারখানার তত্ত্ববধায়ক শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনারা যাচাই-বাছাই করে দেখেন।'

বিস্ফোরণে ৭ শ্রমিকের দগ্ধ হওয়ার ঘটনা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে কারখানা পরিদর্শনে যায় আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসের একটি দল।

আড়াইহাজার স্টেশনের সাব-স্টেশন অফিসার শহীদ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘটনার পর রহস্যজনক কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে কিছু জানায়নি। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে একটি দল পরিদর্শনে যায়। পরিদর্শনে তারা কারখানাটিতে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখেননি। কাজের সময় শ্রমিকদের নিরপত্তার জন্য যে ধরনের নিরপত্তা সরঞ্জাম থাকার কথা সেসবও ব্যবহার করা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।'

ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, 'বিস্ফোরণের কারণ নিশ্চিত করা যায়নি। তবে লোহা গলানোর চুল্লিটি অক্ষত আছে, ধারণা করছি, চুল্লির ভেতরেই কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। পরে গরম লোহা শ্রমিকদের গায়ে এসে পড়ে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানার এক শ্রমিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়া কারখানার লোকজনের অত ভাবার টাইম আছে? একদিন জ্যাকেট দিলে আরেকদিন দেয় না। আমরাও অমনেই কাজ করি। জ্যাকেট থাকলে কী আর এমনে পোড়ে মানুষ? এইডা আপনেরা বোঝেন না? আর সব স্টিল মিল এমনেই চলে।'

পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিকট শব্দে লোহা গলানোর চুল্লিতে বিস্ফোরণ হয়। উত্তপ্ত লোহা পড়ে দগ্ধ হন ৭ শ্রমিক। তাদের মধ্যে শংকর (৪০) নামে একজনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। অপর শ্রমিক ইলিয়াস হোসেন (৩৫) রাত পৌনে ১১টার দিকে মারা যান। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ২০ বছর বয়সী নিয়ন মারা যান। আরও ৪ শ্রমিক আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেখ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন৷

বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. আইউব হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, দগ্ধদের মধ্যে জুয়েলের শরীরের ৯৫ শতাংশ, আলমগীরের ৯০ শতাংশ, রাব্বির ৯৮ শতাংশ এবং ইব্রাহীমের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে৷ তাদের সকলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

তবে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় শুক্রবার দুপুর ১টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি।

জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলা প্রথমত ভিক্টিম বা ভিক্টিমের পরিবার করবে। তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। তারা যদি মামলা না করে সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে থানা পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।'

 

Comments