ত্বকী হত্যা: ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি

র‌্যাব তদন্ত শেষ করতে আরও সময় চাওয়ায় আদালত এ পর্যন্ত তদন্ত শেষ করতে ৭০ বার সময় বাড়িয়েছে
ত্বকী হত্যা
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের আরও একটি বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু গত নয় বছরের মতো এই হত্যা মামলার তদন্ত এখনও চলছে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। এদিকে, ন্যায়বিচারের জন্য ত্বকীর পরিবারের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর কয়েক দিন আগে আশান্বিত হয়েছিলেন শোকাহত বাবা-মা। যখন র‌্যাব দাবি করেছিল যে, তারা হত্যার রহস্য ভেদ করেছে এবং এমনকি একটি খসড়া তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করেছে।

হত্যাকাণ্ডে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা র‌্যাবের খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমে ফাঁস হয়।

আজমেরী ওসমান জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাতিজা।

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে, র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তাদের কাছে ১১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে এবং এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র যেকোন দিন আদালতে জমা দেওয়া হবে।

তবে, দীর্ঘ ১০ বছর পরেও সেই দিনটি আর আসেনি। র‌্যাব তদন্ত শেষ করতে আরও সময় চাওয়ায় আদালত এ পর্যন্ত তদন্ত শেষ করতে ৭০ বার সময় বাড়িয়েছে।

ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'র‌্যাব চার্জশিট তৈরি করেছিল, কিন্তু নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় গত ১০ বছরেও তা আদালতে জমা দেয়নি।'

তার অভিযোগ, সরকারের 'অঘোষিত ইনডেমনিটি' ভোগ করছে ওসমান পরিবার।

র‌্যাবের ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যার কেবল পরিকল্পনাই না, বরং এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন আজমেরী। তার নির্দেশে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তার সহযোগীরা ত্বকীকে অনুসরণ করে এবং তাকে অপহরণ করে শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে উইনার ফ্যাশনে তার 'টর্চার সেলে' নিয়ে যায়।

পরে ওই রাতে, আজমেরী এবং তার সহযোগীরা ১৭ বছর বয়সী ত্বকীকে পিটিয়ে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর তার লাশ বস্তায় ভরে আজমেরীর গাড়িতে করে চারারগোপ এলাকায় নিয়ে যায়।

সেখান থেকে রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে ঘাতকরা নৌকায় করে লাশ নিয়ে কুমুদিনী জোড়া খাল এলাকার শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। পরদিন ৮ মার্চ নদী থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয় বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে ত্বকী নিখোঁজ হয়। পরদিন তার 'এ' লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়, যেখানে দেখা যায় ত্বকী সারাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিলেন।

ত্বকীর লাশ উদ্ধারের পর রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

পরে ওই বছরের ১৮ মার্চ শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের কাছে সম্পূরক অভিযোগ জমা দেন।

পরে রফিউর রাব্বির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করে।

র‌্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে রফিউর রাব্বি তার সমর্থকদের নিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারেন শামীম ওসমান।

২০১৩ সালের ৭ আগস্ট আজমেরীর 'উইনার ফ্যাশন' অফিসে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স, একটি পিস্তলের বাট এবং ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম জব্দ করে র‌্যাব। ওই সময় র‌্যাব কর্মকর্তারা দেয়াল, সোফা ও আলমারীতে বেশকিছু গুলির চিহ্নও দেখতে পান।

ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ত্বকী হত্যাকাণ্ডে ১১ জন অভিযুক্তের প্রত্যেকের ভূমিকার কথা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়।

আজমেরী ছাড়া অন্য অভিযুক্তরা হলেন, ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন জ্যাকি, রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন ও জামশেদ হোসেন।

র‌্যাব অভিযুক্ত লিটন, ভ্রমর, জ্যাকি এবং সন্দেহভাজন হিসেবে রিফাত বিন ওসমান ও সালেহ রহমান সীমান্তকে গ্রেপ্তারও করে। তবে সবাই পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই বছরের জুলাই এবং নভেম্বর মাসে যথাক্রমে লিটন এবং ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে হত্যা পর্যন্ত সব ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন।

যদিও পরবর্তীতে ভ্রমর আদালতে জবানবন্দিতে তার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারেরও আবেদন জানিয়েছিলেন।

ভ্রমর ও লিটনসহ এই মামলার সব আসামি আদালত থেকে জামিন নিয়ে বর্তমানে পলাতক।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, মামলাটি এখনও তদন্তাধীন এবং তদন্ত শেষ হতে আরও সময় লাগবে।

তবে তিনি বলেন, র‌্যাব সদর দপ্তর দ্রুত তদন্ত শেষ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তানভীর বলেন, 'আমরা র‌্যাব সদর দফতরের তদন্ত শাখার সঙ্গে সমন্বয় করে এখন মামলাটি তদন্ত করছি।'

'উপর মহলের নির্দেশে অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে না' পরিবারের এমন অভিযোগের জবাবে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমার ওপর এমন কোন নির্দেশনা নেই। আমরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী তদন্ত করছি।'

তবে বিচার পাওয়ার ব্যাপারে এখনো আশাবাদী ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি।

রাব্বি বলেন, 'ত্বকী হত্যার বিচার হবেই। এই সরকার থাকতে হোক কিংবা পরেই হোক। এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে।'

যা বললেন শামীম ওসমান

ত্বকী হত্যা মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সাথে তিনি কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য সম্পৃক্ত নন। রাজনৈতিকভাবে তার পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের নাম যুক্ত করা হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে একজন পিতা হিসেবে এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই। যেভাবে তার (ত্বকী) পরিবার সন্তুষ্ট হয় সেইভাবেই তদন্ত হোক। যদি সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করে এবং আমি সেই তদন্ত কার্যক্রমকে প্রভাবিত করব বলে সন্দেহ করা হয়, তাহলে প্রয়োজনে তদন্ত চলাকালীন আমার সংসদ সদস্য পদও স্থগিত রাখা হোক।'

তিনি আরও বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের (আলোচিত) সাত খুন মামলার মতো ত্বকী হত্যাকাণ্ডটিকেও রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।

২০১৪ সালের এপ্রিলে ঘটা সাত খুন মামলার উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো- ত্বকী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এই মেজর আরিফরাই (সাত খুন মামলায় দণ্ডিত র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা) করেছিল, যে মেজর আরিফরা অর্থের বিনিময়ে একজন মানুষকে মারতে গিয়ে বিনা অপরাধে সাতজন মানুষকে মেরে ফেলেছিল। যারা এই ধরনের মেন্টালিটি রাখে তাদের তদন্ত কতটুকু সত্য সেটাও দেখার বিষয়।'

'তাছাড়া ওনারা খসড়া চার্জশিটের কথা বলেন, কিন্তু আইনে খসড়া চার্জশিট বলতে কিছু নাই। যদিও ওই খসড়া চার্জশিটেও এই ঘটনার সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রমাণিত হয় না।'

শামীম ওসমান বলেন, 'আমি পরবর্তীতে প্রেস কনফারেন্স করে পাসপোর্ট দেখিয়ে জানাই যে, আমি তখন দুবাইতে আর আমার ছেলে দিল্লিতে ছিল। তখন আমার ভাইয়ের ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। আমার ভাতিজার অফিসে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে লাঠি ও রক্তমাখা প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। তখন ওই রক্তমাখা প্যান্ট ত্বকীর বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ত্বকীর লাশ যখন উদ্ধার হয় তখন তার পরনে প্যান্ট, শার্ট এবং পকেটে টেলিফোন ছিল।'

শামীম ওসমান বলেন, 'উনি (ত্বকীর বাবা) রাজনৈতিকভাবে কোনভাবে মিসগাইডেড হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।'

তিনি বলেন, 'সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ হবেই। একটা বাচ্চা ছেলে মারা গেছে সেই ঘটনার বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।'

শহরের আল্লামা ইকবাল রোডের আজমেরী ওসমানের ব্যক্তিগত কার্যালয় 'উইনার ফ্যাশন' এ র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা প্যান্টটি ২০১১ সালের ১১ মে খুন হওয়া আশিকুল ইসলাম আশিকের বলে দাবি করেছিল তার পরিবার। আশিক হত্যার ঘটনাতেও শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী জড়িত থাকার অভিযোগ করেন নিহতের পরিবার।

এদিকে, আজমেরী ওসমানের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ করা যায়নি। মেসেজ পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

শামীম ওসমানের বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রফিউর রাব্বি বলেন, 'গত ১১ বছরে অনেক ধরনের কথাই উনি (শামীম ওসমান) বলেছেন। এইসব কথাবার্তা নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে চাই না।'

বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বলেন, 'তাৎক্ষণিকভাবে অনেক মামলাতেই আসামির তালিকায় অজ্ঞাত লোকজনের কথা উল্লেখ থাকে কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করেন। ত্বকী হত্যার ক্ষেত্রেও মামলার পর জড়িত সন্দেহে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছিল। আইন অনুযায়ী বিষয়টি গ্রহণযোগ্য, যদিও এজাহারে আসামির নাম যুক্ত হবে না। আর তাছাড়া পরবর্তীতে তাদের সম্পৃক্ততার কথা র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়েও এসেছে।'

তিনি বলেন, 'এত বছরেও মামলার চার্জশিট না দেওয়ায় এখন অভিযুক্তরাই নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে মামলাকে অন্যদিকে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছেন।'

Comments