থানচিতে ডাকাতি: ব্যবস্থাপকদের বিচক্ষণতায় বাঁচল ভল্টের টাকা
বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও লুটের ১৬ ঘণ্টার মাথায় থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলা ও লুটের বর্ণনা উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে।
গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ৪০-৫০ জনের একদল সশস্ত্র লোক তিনটি গাড়িতে করে এসে পাশাপাশি থাকা কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক শাখায় এ হামলা চালায়।
সে সময় ব্যাংকের ভেতরে উপস্থিত গ্রাহকরা বলছেন, হামলা ও লুটের সময় দুই শাখা ব্যবস্থাপকের বিচক্ষণতায় ভল্ট থেকে টাকা নিতে পারেনি ডাকাতরা।
সোনালী ব্যাংকের এক গ্রাহক জানান, ডাকাতদের উপস্থিতি টের পেয়ে ভল্টে তালা দিয়ে এই শাখার ব্যবস্থাপক মো. ফয়সাল দ্রুত টয়লেটে ঢুকে পড়লে কর্মচারীরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেন। ব্যাবস্থাপককে না পেয়ে ক্যাশিয়ার ওমর ফারুকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ক্যাশবাক্স খুলে বস্তায় ভরে টাকা নিয়ে যায় ডাকাতরা।
কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হ্লা শৈ থোয়াই মারমা ডাকাতরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভল্টে তালা দিয়ে গ্রাহকদের সারিতে এসে দাঁড়ান। এসময় অন্যরা ম্যানেজার পালিয়ে গেছেন বলে আওয়াজ তোলেন।
হ্লা শৈ থোয়াই মারমা জানান, ডাকাতরা ভল্ট খুলতে না পেরে ক্যাশ টেবিল ও ড্রয়ারে থাকা দুই লাখ আট হাজার টাকা নিয়ে যায়।
ব্যাংকে আটকে পড়া কয়েকজন গ্রাহক বলেন, ডাকাতরা ব্যাংকের ভেতরে অবস্থান করার এক পর্যায়ে তাদের কাছে থাকা দুটি ওয়াকি-টকির একটিতে প্রথমে বাংলা ভাষায় নির্দেশনা আসে। তাতে বলা হয়—'ঘড়ি দেখ, তোমাদের টাইম শেষ। তোমরা তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাও।'
এর পর আরেকটি ওয়াকি-টকিতে নির্দেশনা আসে বম ভাষায়। বম ভাষাভাষী আরেক গ্রাহক বলেন, 'নিজেদের ভাষায় ডাকাতরা বলছিল যে তাদের সময় শেষ। চলে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি রেডি হও।'
গতকাল থানচিতে ছিল সাপ্তাহিক বাজার। এদিন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন মালামাল নিতে এখানে এসেছিলেন। ব্যাংক লুট শেষে সশস্ত্র দলটি থানচি বাজারে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে এবং ফেরার সময় চারটি জিপে করে থানার সামনে দিয়ে টিঅ্যান্ডটি-ছান্দাকপাড়া হয়ে সাহজাহান বম পাড়ার দিকে চলে যায়।
পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম পার্টি ওই ঘটনায় জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই উপজেলায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফ জড়িত বলে তারা জানতে পেরেছেন।
পাহাড়ে এই সশস্ত্র সংগঠনটির আবির্ভাবের পর থেকে গত দুই বছর ধরে একের পর এক হত্যা-সহিংসতার ঘটনা ঘটে আসছে। কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পর ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ৯ জুন ১৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই ও অগাস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনা হয়।
ভার্চুয়াল আলোচনার পর ৫ নভেম্বর রুমা উপজেলার মুনলাইপাড়ায় কেএনএফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বৈঠকে অংশ নেয়। ওই বৈঠকে ৪টি শর্তের ওপর তৈরি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই পক্ষ। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৫ মার্চ রুমা উপজেলার বেথেলপাড়ায় আরেকটি মুখোমুখি বৈঠকে দ্বিতীয় সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই পক্ষ।
কিন্তু ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনার পর কেএনএফের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বাতিল করার ঘোষণা এসেছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সংবাদ সম্মেলন থেকে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা বলেন, 'সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা তীব্রভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চলমান সকল ধরনের প্রচেষ্টা পদানত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে করে দুই বারের মুখোমুখি বৈঠক ও স্বাক্ষরিত সমঝোতা ভঙ্গ করেছে।
'এমতাবস্থায় এ কমিটি মনে করে যে, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে সংলাপ করার সকল ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।'
Comments