মামলার আসামি কাউন্সিলরকে না পেয়ে ‘চাপে’র মুখে স্ত্রীকে গ্রেপ্তার

চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার মাস্টার, সিবিএ নেতাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে আলোচনা হলেই সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হয়, তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ডের পলাতক কাউন্সিলর ও উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল আলম জসিম।

সরকারি খাস জায়গা, বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গা দখল থেকে শুরু করে পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছিলেন নিজের ত্রাসের রাজত্ব। নিজস্ব বাহিনী দিয়ে পাহাড় কেটে বানিয়েছেন আবাসিক প্লট, করেছেন বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ।

প্রশাসনের অভিযান, মামলা কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। নগরীর আকবর শাহ এলাকার অলিখিত এই 'রাজা' ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মতোই গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান।

বিতর্কিত এই নেতা ও পলাতক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, গুলি ও অর্থ দিয়ে সহায়তার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে।

পলাতক জসিমকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়ে তার স্ত্রী তাসলিমা বেগমকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার বিকেলে তাসলিমাকে (৪০) ডবলমুরিং থানার একটি মামলায় আদালতে তোলা হয়। তাসলিমা এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

নগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, 'চাপে' পরে এবং 'পরিস্থিতি সামাল দিতে' তাসলিমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে, পুলিশের কেউ নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পুলিশ ও আদালত সূত্র জানা গেছে, একে খানের আকবরশাহ এলাকার ১৪তলা গ্রীন গুলবাহার টাওয়ারে পলাতক কাউন্সিলর জসিম লুকিয়ে আছেন—এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত রোববার রাতে ভবনটি ঘিরে রাখেন শতাধিক মানুষ ও 'সমন্বয়ক' পরিচয় দেওয়া কিছু যুবক। এ সময় স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতাকর্মীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ভবনটি ঘিরে রাখার খবরে সেখানে যান আকবর শাহ থানার পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও সিএমপির পশ্চিম জোনের উপ পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হোসাইন কবিরসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা। রোববার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পুরো বাড়ি তল্লাশি করেও জসিমকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে ভবনটির একটি ফ্ল্যাট থেকে তার স্ত্রী ও অপর একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ভবন তল্লাশি করে তাকে (জসিম) সেখানে খুঁজে পাইনি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় অর্থ দিয়ে সহায়তার অভিযোগে তার স্ত্রীকে ডবলমুরিং থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।'

তবে ওসি স্বীকার করেন, ওই মামলায় তাসলিমা এজাহারভুক্ত আসামি নন।

সিএমপির পশ্চিম জোনের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হোসাইন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জসিম ও তার পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তারা অর্থ দিয়েছেন আক্রমণকারীদের। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে সেই মামলায় তাসলিমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'জসিম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে তিনটি মামলা চলমান রয়েছে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জসিম কাউন্সিলর ও তার পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়দের ওপর নানাভাবে চড়াও হয়েছেন, হয়রানি করেছেন। এই নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। রোববার ভবনটি তল্লাশির সময় বাইরে থেকে তালা দেওয়া ও লাইট নেভানো একটি রুম খুলে জসিমের স্ত্রীকে পাওয়া যায়।'

তিনি বলেন, 'এ সময় জসিমের স্ত্রী সেখানে উপস্থিত সমন্বয়ক ও বিএনপির নেতাকর্মীদের গালমন্দ করেন এবং উগ্র আচরণ করেন। এতে বিপত্তির শুরু। তার আচরণের কারণে উপস্থিত সবাই তাকে স্বৈরাচারের দোসর বলে চিৎকার করে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়।'

তার মতে, 'সার্বিক দিক বিবেচনায় ও নিরাপত্তার খাতিরে তাকে আটক করা হয়।'

জসিমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

স্থানীয় সূত্র, পুলিশ ও পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে পাহাড় কাটা শুরু করেন জসিম। আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ করে তার ১২ জনের সহযোগী গ্রুপ। ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় কাটার ঠিকাদারিও করতেন তার অনুসারীরা। পাহাড় কেটে প্লট করে বিক্রির পাশাপাশি জসিম করেছেন গরুর খামার।

এ ছাড়া, আকবর শাহ ও এর আশপাশের এলাকায় কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে জসিমের বিরুদ্ধে। মূলত তাদের ব্যবহার করেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো জসিম।

চট্টগ্রাম সিটির আকবরশাহ থানার উত্তর পাহাড়তলীর লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড় অবৈধভাবে কেটে স্থাপনা নির্মাণের দায়ে জসিম ও তার স্ত্রীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের আগস্টে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. সাখাওয়াত হোসাইন বাদী হয়ে আকবরশাহ থানায় মামলা করেন।

এখন পর্যন্ত পাহাড় কাটার অভিযোগে জসিম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় তিনটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

বেলার প্রধান নির্বাহী ও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের নেতৃত্বে বেলার একটি প্রতিনিধিদল ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি আকবরশাহ থানা এলাকায় নির্বিচারে পাহাড় কাটার স্থান পরিদর্শনে গেলে কাউন্সিলর জসিম ও তার সহযোগীদের হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় রিজওয়ানা হাসান আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

আকবরশাহ থানা পুলিশ ২০২৩ সালের ১২ জুন ছয়জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে অভিযোগপত্রে কাউন্সিলর জসিমকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। পরে আদালত সেটি আমলে নেয়। এই ঘটনায় জসিমকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

Comments