৩ কিশোরকে ৫৬টি গুলি করে হত্যা, আজও বিচারের অপেক্ষায় পরিবার

বিগত এক দশক ধরে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে যাচ্ছেন ৫৪ বছর বয়সী গৃহকর্মী জ্যোৎস্না রবি দাস। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না কোনো আশার আলো। পরিস্থিতি পাল্টে যায় গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। হঠাৎই যেন আবার আশার আলোর দেখা মেলে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুরে যে তিন কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের একজন জ্যোৎস্নার ছেলে। তৎকালীন সময়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির হয়ে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে তাদের এই পরিণতি হয়।
নিহতদের পরিবার বলছে, হত্যাকারীরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। যার ফলে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার না করে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
নিহত সুমনের মা জ্যোৎস্না দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিচার পাওয়ার জন্য আমি পুলিশের কাছে গিয়েছি, আদালতে গিয়েছি। তবুও কিছুই পাইনি।' ছেলের মরদেহের একটি ছবি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
'এইটুকু বয়সী ছেলেটার শরীরে এতগুলো গুলি কীভাবে করল তারা? আমি যখন ঘটনাস্থলে যাই, তখন সরু গলির মাটিতে গুলির খোসাগুলো পড়ে ছিল,' বলছিলেন জ্যোৎস্না।
তিনি আরও বলেন, 'যখনই ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটি, চোখের সামনে আমার ছেলের নিথর দেহ ভেসে ওঠে। আমাদের এলাকায় কেউ বলতে পারবে না যে আমার ছেলে খারাপ ছিল। আমি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। এটাই আমার একমাত্র দাবি। আমি আশা করি বর্তমান সরকার তাদের বিচারের আওতায় আনবে।'
ছেলেবেলায় মা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দাদি হালিমা খাতুনের (৬৫) কাছেই বড় হয়েছেন আরেক নিহত কিশোর রবিন।
'অভাব-অনটনের কারণে আমার নাতি স্কুলে যেতে পারেনি। লেগুনার হেলপারি করত... আমি এখনো ন্যায়বিচারের আশায় আছি,' বলেন হালিমা।
মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নিহতদের পরিবার।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গত ১১ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখার উপকমিশনার মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, 'এটা পুরোনো ঘটনা। এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে পুলিশ বিষয়টি আবার খতিয়ে দেখবে।'

মূল ঘটনা
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে বেগম রোকেয়া সরণির কৃষিবিদ ভবনের কাছে সুমন, রবিন ও জুয়েলকে আটক করে স্থানীয় যুবলীগের একদল সদস্য। তাদের বয়স ছিল ১৪-১৫ বছরের মধ্যে। গণপরিবহনে আগুন দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল সন্দেহে তাদের আটক করা হয়।
ঘটনাস্থলের কাছের দুই দোকানদারের বরাতে জানা যায়, তারা ছেলেগুলোকে ধরে পশ্চিম কাজীপাড়ার বাইশবাড়ি এলাকার একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে গিয়ে হাত বেঁধে নির্যাতন করে।
স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ একটি গলির ভেতর থেকে তাদের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে।
সেই সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিহত কিশোরদের দেহে অন্তত ৫৬টি বুলেটের ক্ষত ছিল।

দায়েরকৃত মামলা
ওই ঘটনার পরদিন মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে নিহতদের বয়স ১৯ ও ২০ বছর উল্লেখ করা হয়।
২০১৭ সালের মে মাসে পুলিশ একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে বলা হয় এটি হত্যাকাণ্ড হলেও কোনো অভিযুক্তকে শনাক্ত করা যায়নি।
তদন্তের প্রতি আস্থা হারিয়ে নিহতদের একজনের পরিবার ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার একটি আদালতে আরেকটি হত্যা মামলা করে। সেই পরিবার ভেবেছিল, আদালত থেকে হয়তো ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। কিন্তু আদালতের নথি অনুযায়ী, ২০১৮ সালের এপ্রিলে মামলাটি 'খারিজ' হয়ে যায়।
মামলার তদন্তকারী গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিদর্শক মো. রফিকুজ্জামান মিয়া ২০১৭ সালের মে মাসে দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে লেখেন, 'অপরাধীদের নাম ও ঠিকানা শনাক্ত করা যায়নি এবং শিগগির তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।'
আদালত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল, যদি ভবিষ্যতে কোনো অভিযুক্ত শনাক্ত হয়, তাহলে পুলিশ আবার মামলাটি খোলার ও অভিযোগ গঠনের সুযোগ পাবে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতরা নিজেদের গ্রুপের মধ্যেই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করছিল। এরপর স্থানীয় জনতা তাদের আটকে মারধর করে এবং পরে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে তারা মারা যায়।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের হরতালের মধ্যে পেট্রোল ও ককটেল বোমা নিক্ষেপ করে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করার সময় নিহতরাসহ ১০ জনকে ধাওয়া দেয় স্থানীয় জনতা। ধাওয়া খেয়ে তারা স্থানীয়দের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
পুলিশের ওই প্রতিবেদনে নিহত কিশোরদের 'দুষ্কৃতিকারী' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানায়, সেদিন ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি।
নিহতদের পরিবার ও স্থানীয়রা জানায়, ছেলেগুলো মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিলেও কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না।
শুরুতে পুলিশ গণমাধ্যমকে জানায়, ছেলেগুলো গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। তবে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়, তিনজন 'অজ্ঞাতনামা অগ্নিসংযোগকারী' জনতার হাতে পিটুনি খেয়ে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।
Comments