‘জনশুমারিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আসেনি’

সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা ও গবেষকরা। তাদের মতে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।
স্টার ফাইল ফটো

সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা ও গবেষকরা। তাদের মতে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১ জন পুরুষ ও ৮ লাখ ২৫ হাজার ৪০৮ জন নারী।

তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষা কর্মীদের দাবি, এই সংখ্যা ৩০ লাখের কম হবে না।

২০১১ সালের আদমশুমারিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৭ জন পুরুষ ও ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬৬৪ জন নারী।

সর্বশেষ জনশুমারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা মাত্র ৬৪ হাজার বেড়েছে এবং তা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও নিচে নেমেছে।

'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, 'সরকার ২০১১ সালের আদমশুমারিতে শুধু ২৪টি ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং সংখ্যা দেখায় ১৫ লাখ ৮৬ হাজার।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এবার ৫০টি জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেওয়া হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে এর প্রতিফলন নেই। জনশুমারি মতে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা মাত্র ১৬ লাখ ৫০ হাজার।

'সুতরাং, এই জনশুমারি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অন্তত ৩০ লাখ হবে', বলেন সঞ্জীব দ্রং।

সর্বশেষ জনশুমারিতে গারো জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা দেখানো হয়েছে ৭৬ হাজার ৮৪৬।

এ প্রসঙ্গে গারো নেতা সঞ্জীব দ্রং ২০১৬ সালের একটি সরকারি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওই প্রকাশনায় ১৯৯১ ও ২০১১ সালে গারো লোকসংখ্যা উল্লেখ করা হয় যথাক্রমে ৬৮ হাজার ২১০ ও ৮৪ হাজার ৫৬৫ জন। 

সর্বশেষ জনশুমারি মতে, বাংলাদেশে ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৯ জন সাঁওতাল বসবাস করেন। কিন্তু সাঁওতাল নেতাদের দাবি, সারাদেশে তাদের সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ হবে।

খ্রিস্টান মিশনারিদের হিসাবের বরাতে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল ১ লাখের বেশি।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি মতে, সাঁওতাল জনসংখ্যা ২ লাখের বেশি।

'বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদ' এর সভাপতি ও সাঁওতাল নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, 'আমরা সংখ্যায় ৫ লাখের কম নই। এর আগে সরকার "আদিবাসী" নাম বদলে "ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী" করেছে। এখন আমাদের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে।'

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা ও গবেষকদের অভিযোগ, দুর্গম এলাকায় তথ্য সংগ্রাহকরা না যাওয়ায় ওইসব এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত তথ্য জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে সশরীরে তথ্য সংগ্রহ করে জনশুমারি করা হয়। প্রতিবেদনে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তথ্য আলাদা করে দেখানো হয়েছে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (এসইএইচডি) কর্মকর্তা ফিলিপ গাইন দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ওপর গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, 'এই জনশুমারি প্রতিবেদন স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৯১ সালে সাঁওতালদের সংখ্যা ২ লাখেরও বেশি ছিল। প্রতিবেদনে এই সংখ্যাটি ১ লাখ ২৯ হাজার দেখানো হয়েছে।'

তিনি আরও জানান, সিলেট অঞ্চলের চা বাগানে বসবাসরত ২৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনশুমারিতে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল জানান, ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করার জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানানো উচিত।

'কিন্তু একইসঙ্গে, জনশুমারির ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এটি তৈরি করার সময় নৃগোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে এটি ঘটেছে। আমার মতে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রকৃত জনসংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষায়িত জনশুমারি আয়োজন করা উচিত', বলেন তিনি।

'পত্র সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদ' এর সভাপতি গৌরাঙ্গ পত্র অভিযোগ করেন, জনশুমারির তথ্য সংগ্রাহকরা তার বাড়িতে আসেননি।

গৌরাঙ্গ আরও বলেন, 'শেষ দিন আমি নিজেই তাদের ফোন করে তথ্য দিয়েছি। ২০২০ সালের আমাদের নিজস্ব জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে পত্র পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭০৫ এবং মোট জনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৯৯৯। এদের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ৭৬ ও নারী ১ হাজার ৯২৩ জন।'

'তবে জনশুমারিতে, পত্র সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৩ হাজার ১০০ জন', বলেন তিনি।

বাংলাদেশ বেদিয়া মাহাতো ইউথ নেটের প্রধান বিভূতিভুষণ মাহাতো দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের ৪১টি গ্রামে বেদিয়া মাহাতো জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বসবাস করেন। নিজস্ব সমীক্ষামতে, আমাদের জনসংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ হাজারের মতো হবে। কিন্তু জনশুমারিতে এই সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৭ হাজার ২০৭।'

সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রিদেশ মুদি জানান, দিনাজপুরে কোরা নৃগোষ্ঠীর ৫০০'র বেশি পরিবারের বসবাস। সিলেট বিভাগের আরও ২৬টি চা বাগানেও এ নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন।

তিনি বলেন, 'আমাদের জনসংখ্যা ২ হাজারের মতো হবে। কিন্তু জনশুমারিতে বলা হয়েছে সংখ্যাটি ৮১৬।'

'চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্ট' এর সভাপতি পরিমল সিং বারাইক জানান, বান্দরবন এবং সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোতে ৮৩টি গোর্খা পরিবার বসবাস করে, যাদেরকে মানুষ মূলত নেপালি হিসেবে চেনে।

তিনি বলেন, '২০২২ সালের জনশুমারিতে গোর্খা জনসংখ্যায় মাত্র ১০০ জনের কথা বলা হয়েছে।'

খড়িয়া সামাজিক মানবাধিকার কর্মী পিউস নানাউর ২০২০ সালের প্রথম দিকে তার সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সিলেট বিভাগের ৪১টি গ্রামে ৫ হাজার ৭০০ খড়িয়া মানুষ খুঁজে পেয়েছেন।

তবে এ বছরের জনশুমারিতে সংখ্যাটি ৩ হাজার ৯৯ দেখানো হয়েছে।

'কেউ আমার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে আসেনি', বলেন তিনি।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে মাঠ পর্যায়ের জনশুমারি কার্যক্রমে অংশ নেন রাম পাপাং। তিনি জানান, শুরুতে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত ৩টি গ্রামে সমীক্ষা চালানো হয়নি।

'পরবর্তীতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা এ বিষয়ে অভিযোগ জানায়। তারপর আমি শেষ দিনে সেখানে গিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছি', বলেন তিনি।

শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট ইউনিয়নের জনশুমারি সুপারভাইজার রিপন বন্দোপাধ্যায় জানান, কিছু তথ্য সংগ্রাহক 'ঝামেলা এড়াতে' তাদের ডিভাইসের 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' অপশনটি ব্যবহার করেননি।

সর্বশেষ জনশুমারি প্রকল্পের কারিগরি প্রধান ড. দীপংকর রায় বলেন, 'মানবাধিকার কর্মীরা অনেক কিছুই বলতে পারেন; তারা তাদের ইচ্ছেমতো যেকোনো সংখ্যা অনুমান করতে পারেন। কিন্তু জনশুমারি প্রতিবেদনটি তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।'

উপ-সচিব দীপংকর রায় আরও বলেন, 'অনেকেই অনুমান করেছিলেন দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ বা ২০ কোটি হবে, কিন্তু জনশুমারিতে তা আসেনি। আমরা মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ পেয়েছি। এটাই বাস্তবতা।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments