‘তন্ত্র ও তান্ত্রিক’

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পোলট্রি ব্যবসায়ী ফারুকের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। ৪ বছর আগে একই গ্রামের পছন্দের মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরে তারা ঢাকায় সংসার শুরু করেন। তাদের প্রথম সন্তান হওয়ার পরেই দাম্পত্য কলহের কারণে ফারুকের স্ত্রী গ্রামে তার বাবার বাড়িতে চলে যান।

এরপর ৩ মাস কেটে যায় কিন্তু তার স্ত্রী আর ফিরে আসতে রাজি হননি। সে সময় তিনি কারওয়ান বাজারে তার দোকানের পাশে 'রায়হান তান্ত্রিক' এর পোস্টার দেখতে পান। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, দৈব শক্তির মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার ভেতরে দাম্পত্য কলহ দূর করা হয়।

ফারুক ফোন করলে রায়হান তাকে 'আস্তানায়' যেতে বলেন। ফারুকের সমস্যা শুনে রায়হান আশ্বাস দেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান করে দেবেন। তিনি ফারুককে ১৫ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর ব্যবহৃত কাপড় নিয়ে যেতে বলেন।

কথা মতো ফারুক কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে যান। ফারুককে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো ঘরময় ধোঁয়া, সামনে রাখা ধাতবপাত্র। ঠিক যেন রহস্য সিনেমায় দেখা কোনো দৃশ্য। পেছন থেকে কিছু 'অপরিচিত' শব্দ আসতে থাকে। ফারুকের মনে হয়, তিনি যেন এক অলৌকিক জায়গায় পৌঁছে গেছেন।

রায়হানের সঙ্গে দেখা করার ২২ দিন পার হয়ে যায়। এর মধ্যে সব প্রথাগত কাজও শেষ হয়েছে। তারপরও ফারুকের স্ত্রী ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানান। ফারুক তখন রায়হানকে ফোন করে টাকা ফেরত দিতে বলেন।

রায়হান বলেন, 'নিশ্চয়ই তুমি কোনো ভুল করেছো। আবার নতুন করে মন্ত্র পড়ে কাজ শুরু করতে হবে।'

আবারও টাকা দাবি করেন রায়হান। তবে শেষ পর্যন্ত ফারুকের সংসার টেকেনি।

এ রকম অসংখ্য গল্প চারপাশে ছড়িয়ে আছে। এসব তান্ত্রিকদের কাছে সব ধর্ম, শ্রেণি পেশার মানুষ যাতায়াত করেন। বছরের পর বছর এভাবেই চলে আসছে। নতুন নতুন মাধ্যমে তারা মানুষের কাছে পৌঁছান।

তান্ত্রিকদের একটি সুপরিচিত কৌশলের নাম 'বাটি চালান'। এর মাধ্যমে তারা হারানো কোনো জিনিসের সন্ধান দেন। পাশাপাশি দাম্পত্য কলহ মীমাংসা, আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সমাধান, মামলা জিতিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন তারা। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে পোস্টার দেখা যাচ্ছে, আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে লোডশেডিং দূর করা হয়।

দরিদ্র্যতার কবলে পড়ে বেদে সম্প্রদায়ের অনেকেই এই পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।

এসব বিজ্ঞাপন দেখে সরেজমিনে ৩টি গ্রাম ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক।

সাভারের বেদেপল্লীতে গিয়ে সন্ধান মেলে 'খোকা কবিরাজের'। তার বয়স আনুমানিক ৭৮ বছর। তার দাবি, ভারতের কামরুক কামাঙ্ক্ষা প্রায় ১২ বছর তিনি তন্ত্র শিক্ষা নিয়েছেন। খোকা এই পেশায় আছে অন্তত ৪৫ বছর।

কয়েকজন নারীর কাছে খোকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। খোকা কবিরাজকে সবাই চেনে কিন্তু কেউ ঠিকানা দিতে চায় না। সেখানে আরও কিছু তান্ত্রিকের খোঁজ পাওয়া যায়। রিকশা চালক, বই বিক্রেতা, মুদি দোকানদার এমন বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজেদের তান্ত্রিক দাবি করেন। তারা খোকার কাছে না গিয়ে তাদের কাছে সমস্যা জানানো পরামর্শ দেন। সমাধান করে দেবেন বলেও আশ্বাস দেন।

খোকার আস্তানায় গিয়ে দেখা যায়, একটি টিন দিয়ে ঘেরা ঘর। অনুসারীদের দাবি, খোকা প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ জন গ্রাহকের সঙ্গে দেখা করেন। ভারত ও নেপাল থেকেও তার কাছে সমস্যা সমাধানে অনেকে আসেন। ঘরের দেয়ালজুড়ে আরবি ভাষায় লেখা কাগজ। ঘরের ভেতরে একটি চৌকি ও চেয়ার রাখা। সাধারণ পোশাক পরে খোকা সামনে আসেন। তবে তার হাতে ৩টি সোনার আংটি এবং গলায় সোনার দুটি চেইন।

প্রতিবেদককে দেখেই খোকা বলেন, 'আপনি সম্প্রতি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।'

এই প্রতিবেদক তার পরিচয় গোপন রাখেন। বিস্ময় নিয়ে খোকাকে প্রশ্ন করেন, 'আপনি আমার সম্পর্কে আর কী কী বলতে পারবেন?' খোকা বলেন, 'আপনার পিঠের বাম পাশে একটি তিল আছে।' কাকতালীয় হলেও খোকার এই কথা মিলে যায়।

খোকা প্রস্তাব দেন, '২ হাজার ১৫০ টাকা দিলে তিনি একটি তাবিজ দেবেন। তাতে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। 'আমি জ্বিন হাজির করতে পারি কিন্তু তার জন্য ৫ হাজার ২০০ টাকা ও একটি কাঁসার থালা কিনতে হবে।'

এই প্রতিবেদক তাবিজ নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং ফিরে আসেন।

এ ধরনের তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন অনেকের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়। আর্থিক লেনদেনের কোনো নথি না থাকায় তারা কেউ অভিযোগ করতে পারেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মঈনুল ইসলাম বলেন, 'আমরা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Money laundering: NBR traces Tk 40,000cr in assets abroad

The National Board of Revenue has found assets worth nearly Tk 40,000 crore in five countries which it believes were bought with money laundered from Bangladesh, said the Chief Adviser’s Office yesterday.

3h ago