‘বাবু পিঠের ঝুড়ি পেটে ঠেকছে’

চা-শ্রমিক
শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের শ্রমিক। ছবি: স্টার

সম্প্রতি ব্যক্তিগত কাজে রাজধানী ঢাকায় গিয়েছিলেন চা-শ্রমিক দয়াল অমলিক। সেখানে পরিচিত একজনকে ধূমপান করতে দেখে জানতে চাইলেন, তিনি ধূমপানের পেছনে দিনে কত টাকা ব্যয় করেন। জবাব পেলেন ২০০-৩০০ টাকা। দয়াল তাকে বললেন, 'একজন চা-শ্রমিক প্রতিদিন ১২০ টাকা মজুরি পায়।' তখন সেই পরিচিত ব্যক্তিটি আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেননি।

এভাবেই নিজেদের অবস্থার তুলনা করছিলেন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা বাগানের শ্রমিক দয়াল অমলিক।

একই বাগানের চা শ্রমিক সঞ্জা ঘাটুয়াল ডেইলি স্টারকে বলেন, '১২০ টাকা দিয়ে আপনি কতটুকু চাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, ডাল কিনতে পারবেন? পুষ্টিকর বা সুষম খাবার তো অনেক দূর। চা শ্রমিকরা দিনের পর দিন একবেলা খেয়ে আর উপোষ থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যারা রেশনে চাল বা আটা পায়, তারা একবেলা খেতে পারে। অনেকে সকালে একমুঠো চাল ভাজি করে রঙ চা দিয়ে খেয়ে কাজে যায়।' 

'রাতে কোনোমতে মাড়ভাত খাইয়ে ঘুমাই যায়। কিন্তু কামে গেলে শুধু ভুখ লাইগে যায়। বাবু পিঠের ঝুড়ি তো এখন দেখি পেটে ঠেকছে,' বলেন তিনি।

চা-শ্রমিক
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের আন্দোলন। ছবি: স্টার

গবেষক অধ্যাপক চিত্ররঞ্জন রাজবংশী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা বাগানের অস্থায়ী থেকে স্থায়ী শ্রমিক হওয়া আরেক যুদ্ধ। শ্রম আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে স্থায়ী করার নিয়ম আছে। তবে ৬-৭ বছর কাজ করেও স্থায়ী হতে পারেননি, এমন অসংখ্য শ্রমিক আছেন। তারা বলছেন, স্থায়ী শ্রমিকের পিএফ (প্রভিডেন্ড ফান্ড) কাটা হয়। অবসরের পর তিনি কিছু টাকা পান, যা শেষ জীবনে কাজে আসে। যত দেরিতে স্থায়ী শ্রমিক করা যাবে, তত কম টাকা দিতে হবে। তাই স্থায়ীকরণে টালবাহানা করা হয়।'

তিনি জানান, চা বাগানে কাজের পাশাপাশি কেউ কেউ বাইরে ইট ভাটা, রাস্তা বা ধানখেতে দিনমজুরের কাজ করে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তবে সব বাগানের শ্রমিকদের বাইরে কাজ করার সুযোগ নেই। এমনকি বাইরে কাজে গেলে বরাদ্দকৃত ঘর বাতিল বা পরবর্তীতে চা বাগানে স্থায়ী কাজের সুযোগ হারানোর ঝুঁকিও থাকে। 

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চা-শ্রমিকদের মানবেতর জীবন সংগ্রামের কথা জানান দলদলি চা বাগানের যুব সংঘের সভাপতি মনোরঞ্জন দাস।

বাংলাদেশীয় চা-সংসদ সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের আলোচনা চলছে। আলোচনা বন্ধ করছি না। তারা চাইলে আমরা মিটিং ডাকব। দাবি-দাওয়ায় ১০০টা পয়েন্ট থাকে। এজন্য আলোচনায় সময় লাগে। সরকারের পক্ষ থেকে ডিজি (শ্রম অধিদপ্তরের) চিঠি দিয়েছেন। চা-পাতা না তুললে দুই পক্ষেরই ক্ষতি। এ মৌসুমে একজন শ্রমিক ৫০-১০০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারে। সপ্তাহে ২-৩ হাজার টাকা বেশি রোজগার হয় তাদের।'

ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যানের দাবি, একজন চা-শ্রমিকের পেছনে মজুরি, রেশন, বাসা, মেডিকেল, বোনাসসহ মালিকের মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন দেশের চা বাগানের শ্রমিকরা। কয়েকদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তারা কাজ বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যূনতম মজুরিতে তাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।'

তাই 'কাজে না গেলে মজুরিহীন অবস্থায় অভুক্ত থাকার' ঝুঁকি নিয়েও লাখো শ্রমিক আন্দোলনে নেমেছেন বলে জানান তিনি।

চা-শ্রমিক নেতা সিতারাম বীন জানান, চা-শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামের মধ্যে শিশুদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ হয় না। তাই শ্রমিক জীবনের চক্রেই আটকে পড়ে তারা। ন্যূনতম মজুরিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্রীতদাসের মতো তাদের বাগানের শ্রমিক জীবন মেনে নিতে হয়।

তিনি আরও জানান, প্রায় ২০ মাস ধরে শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। চা বাগানের মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা দৈনিক ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন।

চা-শ্রমিক
চা-শ্রমিকদের আন্দোলন। ছবি: স্টার

দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মিন্টু দাস জানান, একজন শ্রমিক দৈনিক ২৩ কেজি চা পাতা চয়নের পর নির্ধারিত ১২০ টাকা মজুরি পান। এরপর বাগানভেদে বাড়তি প্রতি কেজি চা পাতা চয়নে আড়াই থেকে ৫ টাকা পান। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বর্তমান মজুরি কার্যকর হওয়ার আগে চা শ্রমিকরা ১০২ টাকা করে মজুরি পেতেন। সেই সময় দ্রব্যমূল্য এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৯ সালে সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণের সময় চালের কেজি ৩০ টাকার কাছাকাছি ছিল। এখন তা ৬০ টাকা। ২০২১ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা ৩০০ টাকা মজুরির কথা বলেছিলাম। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে ৩০০ টাকাও কম হবে। চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি কারও দরদ নেই।' 

যোগাযোগ করা হলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর শ্রীমঙ্গলের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামীকাল মঙ্গলবার শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী আসবেন। তিনি প্রথমে বাংলাদেশ চা–শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বসবেন। পরে তাদের দাবি নিয়ে বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।'

'এখন যেহেতু ধর্মঘটের কারণে দুই পক্ষের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তাই শুরুতেই দুই পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান কঠিন হবে। ইতোমধ্যেই উভয় পক্ষকে মহাপরিচালকের সঙ্গে বসার জন্য বলা হয়েছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Foreign debt repayment surges 25%

Bangladesh’s repayment of foreign loans surged in the first 10 months while the inflow of loans from bilateral and multilateral lenders continued to fall, according to provisional data from the Economic Relations Division (ERD) released yesterday.

2h ago