৭৬ বছর পর ভিটেমাটির খোঁজে

ফেলে যাওয়া বাড়ির পাশে স্থানীয় একজনের সঙ্গে স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে আবেগ তাড়িত গায়ত্রী কুন্ডু। ছবি: একুশ তাপাদার

৫/১ পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেন, ঢাকা। বাড়ির সামনে একটি কাঁঠালি চাঁপা গাছ। গায়ত্রী কুণ্ডুর সঙ্গী ছিল এইটুকু ঠিকানা। আর ছিল শৈশবের ভরপুর স্মৃতি। বয়স আশি পেরুলেও সেইসব স্মৃতি যেন সতেজ হয়ে তার চোখেমুখে দিচ্ছিল আভা।

৭৬ বছর আগে ১৯৪৬ সালে খুব ছোটবেলায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে থিতু হয়েছিলেন গায়ত্রী। দেশভাগের ঠিক আগে সেই সময়টা দাঙ্গায় উত্তাল এই অঞ্চল। অসময়টা তখন উপমহাদেশটাকে রক্তাক্ত করছে বিস্তর। যে ক্ষতের যন্ত্রণায় এখনো বিদ্ধ লাখ লাখ মানুষ।

পূর্ববঙ্গ ছেড়ে তখন পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েও অনেকের এই পারে আসার মিছিল তীব্র। সাম্প্রদায়িক বৈরিতার তোড়ে গায়ত্রীও হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের বাড়ি, ঠিকানা।

তার ফেলে যাওয়া ঢাকা পরে পাকিস্তান নামক ভয়াল রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতো তারও আর ফেরার অবস্থা ছিল না। ১৯৭১ সালে পরে জন্ম নিল বাংলাদেশ। ততদিনে ভারতের নাগরিক হয়ে আলাদা একটা ঠিকানাও হয়ে গেছে গায়ত্রীদের। বাংলাবাজারে বইয়ের দোকানের ব্যবসা আর পিসি ব্যানার্জি লেনের বাড়ি তখন কোন সুদূরের অতীত।

নিজের ফেলে যাওয়া সেই ঠিকানার সামনে গায়ত্রী কুন্ডু। ছবি: একুশ তাপাদার

সীমানা আর পাসপোর্টের পরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতায় উঠে যাওয়া অদৃশ্য দেয়াল বছর পর বছর কেবল দূরত্বই তৈরি করে রেখে গেছে। ইচ্ছে থাকলেও তাই নানাবিধ জটিলতায় ফেরাটা আর আলোর মুখ দেখেনি।

৭৬ বছর পর তিনি বাংলাদেশে আসলেন এবার। জীবন সায়াহ্নে এলে নাকি শৈশব খুব আক্রান্ত করে মানুষকে। তার ভেতরেও হয়ত চলছিল এমন কোনো ভ্রমণ।

গায়ত্রী মাসীমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় তার মেয়ের বন্ধু শান্তা ভট্টাচার্যের মাধ্যমে। তার মেয়ে দেবাঞ্জলি কুন্ডুও এখন আমাদের বন্ধু। কলকাতায় শিক্ষকতা করেন তারা।

আমার বন্ধু সৌরভ চৌধুরী মাসখানেক আগে জানাল, বাংলাদেশে নিজের জন্মভিটে খুঁজতে আসবেন একজন বয়স্ক নারী। তখন থেকেই রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা।

অনেকের গল্পে এরকম শেকড়ের সন্ধানের কথা পড়েছি। কিন্তু কখনো কারো সেই সন্ধানের পথে সঙ্গী হওয়া হয়নি। এবার হলো, অদ্ভুত এক আবেগীয় যাত্রায় থাকলাম আমরা।

পুরান ঢাকায় পোগোজ স্কুলে পড়তেন গায়ত্রী কুণ্ডুর দাদা। সেই স্কুলের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ছবি: একুশ তাপাদার

১৯ অগাস্ট শুক্রবার গায়ত্রী মাসি, দেবাঞ্জলি ও শান্তার সঙ্গে আমরা মিলিত হলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে। এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৪৮ সনে। ইতিহাসের বহু স্পর্শ লেগে থাকা ভবন থেকেই আমাদের অতীত যাত্রা শুরু। পোগোজ স্কুলেই পড়তেন উনার জ্যাঠতুতো দাদা।

বাড়ি খুঁজতে যাওয়ার আগে পুরনো এই স্কুল ভবনে বসে রবীন্দ্রনাথের 'দুই বিঘা জমি'র কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করছিলেন গায়ত্রী, 'সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য/ কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য/ ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি/ তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।'

তার মনের ভেতর কী খেলা চলছিল আঁচ করা যায়। শেকড় হারানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে অবশ্যই সেই ভ্রমণের পুরোটা অনুভব করা সম্ভব না।

পুরান ঢাকায় অলিগলি বিস্তর। ছোট ছোট সেসব গলির মধ্যে কোনটা পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেন তা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়ে খোঁজাখুঁজির পরিকল্পনা করছিলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোথায় সেই, পূর্ণ চন্দ্র ব্যানার্জি লেন।

কাকতালীয়ভাবেই মিলে গেল সন্ধান। বিউটি বোর্ডিংয়ে হুট করে আসা শিংটোলার পঞ্চায়েত প্রধান আলমগির সিকদার লোটন করে দিলেন সমাধান। গায়ত্রী মাসীমার সঙ্গে আলাপে তিনি ঠিকানা শুনে জায়গাটা চিনে ফেললেন। পরে কাজী নাদিম নামে একজন প্রতিবেশীর খোঁজ মিলল।

এখানেই ছিল তার আগের বাড়ি। এখন নতুন ভবন হয়েছে। একটু স্পর্শ করে দেখতে চাইলেন। ছবি: একুশ তাপাদার

তারাই আমাদের নিয়ে গেলেন গায়ত্রী মাসিমার ভিটেতে। গলিটা আগের মতো থাকলেও বদলে গেছে চারপাশটা। অনেক পুরনো বাড়ি আর আগের জায়গায় নেই। এখনকার শ্রীহীন ভবনগুলোর দাপট ফাঁকা জায়গাগুলোও কেড়ে নিয়েছে। অলিগলি পেরিয়ে, নানান স্মৃতির ভ্রমণ শেষে একটা সময় গিয়ে ৫/১ বাড়িটার সামনে পড়লাম আমরা। কিন্তু সেই বাড়িটা তো আর আগের মতো নেই। জানা গেল,  ২০০৩ সাল পর্যন্ত পুরনো দোতলা ভবনটি ছিল, সামনের ফাঁকা পরিসরও। এরপর তা ভেঙে একটি উঁচু অট্টালিকা বানিয়েছেন এখানকার মালিকরা। বাড়িটা আর আগের মতো না থাকার কষ্ট টের পাচ্ছিলাম, বাতাসটা ভারি লাগছিল খুব।

বাড়ি নেই, কিন্তু মাটি তো আছে। গায়ত্রী সেখানে ঢুকেই বলতে লাগলেন, 'এই পাশটায় ছিল কাঁঠালি চাঁপা গাছ, ওই দিকে চৌবাচ্চা, অপর পাশটায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়দের বাড়ি, বা পাশের বাড়িতে কীর্তন হতো। উপরের ওই ঘরটায় মা থাকতেন। আমার জন্মটা তো এখানেই…' তার চোখে তখন মেঘ জমেছে, স্মৃতির মেঘ। কাঁঠালি চাপা গাছের নিচের মাটি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই গাছটাই আর নেই।

বাড়ি নেই, বদলে যাওয়া সময়ের তোড়ে অনেক কিছু বদলে গেছে। গায়ত্রী মাসী তবু আনন্দ খুঁজলেন না থাকার মাঝেও কিছু থাকায়, 'এখন যখন এসে দেখলাম বাড়িটা নেই। তখন মনকে শক্ত করলাম, কী করা যাবে! তবু এতগুলো লোক আমার জন্য কষ্ট করল, আমি এসেছি সেজন্য, সেটা আমার আনন্দের।'

'লোকটাকে (নাদিম) জিজ্ঞেস করছিলাম মূল গেট কোনটা। মূল গেটটা একটু অন্যরকম ছিল। পরে লোকটা আমাকে সব হুবহু বলল। গাছটা এখানে ছিল, লম্বা একটা বারান্দা ছিল। ওটা পেরিয়ে সিঁড়ি ছিল, একতলায় রান্নাঘর ছিল।'

খুঁজে পাওয়া গেছে ফেলে যাওয়া ঠিকানা, কিন্তু চেনা যাচ্ছে না ভবন। ছবি: একুশ তাপাদার

অনেক বদলের ভিড়ে পাশের পাঠশালার পুরনো ভবনটা চিনতে পারলেন তিনি। সেটা আছে আগের মতো। সেই পাঠশালায় পড়তেন তার জ্যাঠতুতো দিদি। পরে তিনি পড়েছিলেন অভয় দাস লেনের কামরুন্নেসা বালিকা স্কুলে। সেসবও মনে আছে তার।

তাদের মূল বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জে, সেই বাড়িটার কথা তার কিছু মনে নেই। যে বাড়িটার কথা মনে আছে সেই বাড়িটাও নেই এখন আর, 'আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জে। আমরা থাকতাম ঢাকাতেই। দেশভাগের পর সেই বাড়িটার কিছুই আর আমরা পাইনি। ঢাকার এই বাড়িটা ছিল আমার পিসির। পিসেমশাই মারা গিয়েছিলেন। পিসির কোনো সন্তান ছিল না। আমার জ্যাঠার পরিবার, আমাদের পরিবার আমরা সবাই মিলে এই বাড়িতে থাকতাম। এখানেই আমার জন্ম, আমার চার ভাইবোনের জন্ম। আমাদেরই বাড়ি ছিল এটা। আমার বাবা-জ্যাঠারা সাহিত্য ভালোবাসতেন। সবাই লিখতেন। বইয়ের ব্যবসা ছিল। সব উঠে গেল।'

৭৬ বছর দীর্ঘ সময়। এই ভূখণ্ড এরমধ্যে দুবার পরিচয় বদলেছে, মানচিত্র বদল হয়েছে। রাজনীতি কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু, তৈরি করেছে নতুন নতুন সমীকরণ। কিন্তু শেকড়ের টানটা তো বদলায় না।

বাড়িটা যদিও আগের মতো নেই, তবু ঠিকানা তো পাওয়া গেল। কেমন অনুভূতি হচ্ছে? এই প্রশ্নে বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে গায়ত্রী মাসিমা বললেন, 'খুব শান্তি লাগছে। সব মিলে গেল তো। ওই ভদ্রলোক (কাজী নাদিম) থাকাতে খুব সুবিধে হলো।'

২০ বছর আগে বাড়িটা যেমন ছিল নাদিম বর্ণনা করছিলেন। গায়ত্রী তুমুল রোমাঞ্চ নিয়ে সেইসব বর্ণনায় সায় দিচ্ছিলেন, তিনি আরেকটি কথা বলছিলেন, নাদিম সায় দিচ্ছিলেন।

শিংটোলার পাঠশালার সামনে। এই ভবনটা আগের মত আছে। বাড়ি খুঁজতে যাওয়া পুরো দলকে নিয়ে গায়ত্রী। ছবি: দেবাঞ্জলি কুন্ডূ

কলকাতায় পাড়ি দেওয়ার পর সেখানেই বেড়ে উঠেন গায়ত্রী। তারপর বিয়ে হয়ে নতুন ঠিকানা হয় হাওড়ায়। সরকার থেকে নামের সঙ্গে পদবি বদলে হয় কুণ্ডু। এবার হাওড়া থেকেই খুঁজতে এলেন নিজের ফেলে যাওয়া স্মৃতি। কাকতালের ব্যাপার হলো যিনি তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করলেন সেই নাদিমের পূর্বপুরুষ এই দেশে এসেছিলেন হাওড়া থেকেই। দুজন শেকড় হারানো মানুষের আলাপন দীর্ঘ হলো।

দেবাঞ্জলি তার মাকে জন্মভিটায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বছর সাতেক আগেই। ২০১৫ সালে পাসপোর্ট করিয়েও আসা হয়নি বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। দেবাঞ্জলি বললেন, দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় এবারও আসতে পারবেন কিনা শঙ্কার মেঘ জমিয়েছিল,  '২০১৫ সালে পারলাম না। ২০১৭ সালে আমার বড় মামাও আসতে চাইলেন, তারও জন্ম এই বাড়িতে। কিন্তু বড় মামা অসুস্থ হয়ে গেলেন। পরে করোনা এল, বড় মামাও মারা গেলেন। আসা হলো না। এই বছর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাকে নিয়ে আসবই। না হলে পরে কী হয়ে যায়…।'

বয়স হয়ে গেছে, শরীর নরম হয়ে গেছে। এবার না এলে হয়ত তার আর আসাই হতো না। একটা তীব্র আক্ষেপ নিয়ে ফুরিয়ে যেত জীবন।

রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমির প্রসঙ্গ শেষেও এসে আবার টানলেন গায়ত্রী মাসি, 'মনে হচ্ছে উপেনের মতো আমি এসেছি দেশে। সেই যে জমিদার ওকে যে উচ্ছেদ করে দিল। তারপর এলো ঘুরে ঘুরে। তারপর আম পড়ল। ও মনে করল দেশমাতাই তাকে দিল।'

দেশমাতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, দেশমাতার শরীরের ঘ্রাণ মেখে ফিরে যাবেন তিনি। এও তার কাছে পরম শান্তি।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago