রমনা জোনের এডিসি হারুন

‘তিনি শুধু পেটান’

গত ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ব্যথায় কাঁতরাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামি আবদুল্লাহ। তখন তার মাথায় ১৪টি সেলাই।
আন্দোলনকারীদের পেটানো রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের যেন অভ্যাস। ছবি: স্টার/ সংগৃহীত

গত ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ব্যথায় কাঁতরাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামি আবদুল্লাহ। তখন তার মাথায় ১৪টি সেলাই।

এই শিক্ষার্থী জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেদিন 'শান্তিপূর্ণ' প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ব্যাপক লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে তিনিসহ অন্তত ১২জন আহত হন। 

শাহবাগে এক আন্দোলনকারীকে পেটাচ্ছেন এডিসি হারুন। ছবিটি গতকাল শুক্রবার তোলা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

সেদিনের ঘটনায় নেতৃত্বে দেন রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। এডিসি হারুন সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের মন্তব্য হলো 'তিনি (এডিসি হারুন) শুধু পেটান।'

শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশে লাঠিপেটার ঘটনা সম্পর্কে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, 'শান্তিপূর্ণ' কর্মসূচিতে সেদিন অতর্কিতভাবে লাঠিচার্জ করে পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, রাজধানীর রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে 'শান্তিপূর্ণ' এবং 'গণতান্ত্রিক' কর্মসূচিতে 'বিনা উস্কানিতে' বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। শুধু এটা নয়, এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরাও একই অভিযোগ করেছেন। 

ছবি: সংগৃহীত

এর আগে, নিজ সহকর্মীকেও চড় মেরে সমালোচিত হয়েছিলেন এডিসি হারুন। নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান মালিক, বিক্রেতা ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের দিকে রাবারের বুলেট ছুড়তে এক কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন তিনি। বুলেট শেষ বলায় তাকে চড় মারেন তিনি। ঘটনাটির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পরলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন এডিসি হারুন। 

তার নেতৃত্বে শাহবাগে সমাবেশকারীদের পেটানোর ঘটনা, এমনকি তিনি নিজেই লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন—এমন ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। এমন সময় রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশিদের নির্দেশনায় তিনিসহ অন্যসহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের পেটাতে শুরু করেন।

পেটানোর আগে তার গায়ে জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন তার সহকর্মীরা। হেলমেট পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারমুখো হয়ে উঠেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের অমানুষিকভাবে লাঠিপেটা করেন।

এ প্রসঙ্গে ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেদিন শাহবাগে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ লাঠিপেটা না করলে মিছিল নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে চলে যেতাম। কোনো উত্তেজনা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।' 

রাজধানীর ডিএমপি রমনা জোনের আওতাধীন এলাকার মধ্যে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও হাইকোর্ট, জাতীয় প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানে দেশের আলোচিত বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এর আগে যারা রমনা জোনের দায়িত্বে ছিলেন তাদের কাউকে নিয়ে এ ধরনের কোনো সমালোচনা হয়নি। এডিসি হারুন 'উগ্র আচরণ' করেন বলে অভিযোগ করেন তারা। 

বিভিন্ন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে রমনা জোনের এডিসি হারুনের নাম শুনেই তারা অসন্তোষ জানান। কোনো যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে বেপরোয়াভাবে পেটানোর অভিযোগ করেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান।

বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশের মারধরের শিকার হওয়া ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অতিদ্রুত এডিসি হারুনকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশে না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিভিন্ন সময় দেখেছি এডিসি হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ বেপরোয়াভাবে বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে। তিনি নিজেও বিক্ষোভকারীদের পেটান। একজন পুলিশ কর্মকর্তা এমন উগ্র আচরণ প্রত্যাশিত না।'

চলতি বছরের ৪ মার্চ গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ মিছিলে ঢাকা ক্লাবের সামনে রমনা জোনের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ও সাদা পোশাকের লোক বিক্ষোভকারীদের ওপর অতর্কিত লাঠিচার্জ করে।

এ ঘটনার অন্তত তিন জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, সেদিন গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক ‍নূরের নেতৃত্বে একটি 'শান্তিপূর্ণ' মিছিল বের করা হয়েছিল। পুলিশ সে মিছিলে লাঠিচার্জ করে।

ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে নুরুল হক ‍নূর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছাত্র অধিকার পরিষদের একাধিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। তিনি নিজেই আমাদের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে গলা টিপে ধরেছেন। রমনা জোনের পুলিশের যে মারমুখি আচরণ সেদিক থেকে সামনের সারিতে আছেন হারুন। যিনি ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সরকার অবৈধ ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য পুলিশ বাহিনীকে বেপরোয়া করে তুলছে।'

একই অভিযোগ করেছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে পুলিশ ছাত্রদলের 'শান্তিপূর্ণ' সমাবেশে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠন আয়োজিত মশাল মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ।

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত, তারা বলেন, 'সেদিন বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে টিএসসি থেকে শাহবাগে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এডিসি হারুনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বিক্ষোভকারীদের মারধর করে আহত করেন।' 

এদিকে ১৫ আগস্ট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করায় বরগুনার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মহরম আলীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। মহরমের নেতৃত্বে সেদিন বরগুনা পুলিশের একটি দল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করে। অভিযোগ ছিল যে, ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী সেদিন ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশের ভ্যানের উইন্ড-শিল্ড ভেঙে ফেলে। চট্টগ্রামে বদলি হওয়ার এক দিনের মধ্যে মহরম আলীকে প্রত্যাহার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দপ্তর সম্পাদক সালমান সিদ্দিকী বলেন, 'ছাত্রলীগের ওপর লাঠিচার্জ করায় বরগুনার একজন এএসপির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া প্রমাণ করে যে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আচরণ করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দ্বিচারিতা রয়েছে।'

'পুলিশের ক্ষেত্রে এই ধরনের দায়মুক্তি থাকলে তারা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে উৎসাহী হয়,' বলেন তিনি।

পুলিশের এমন আচরণের সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশের কাজই হলো সাধারণ জনগণের জীবন রক্ষা করা। কারণ নাগরিকদের করের টাকায় তার বেতন হয়। পুলিশের এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য না।'

'এটা ব্যক্তির চেয়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, তাদের মনোজগতের বহি:প্রকাশ। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করা হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড তখনই ঘটে, যখন কোনো জবাবদিহিতা থাকে না, যার কারণে তারা উৎসাহিত হয়,' বলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ পাবলিককে পেটাতে পারে না, যদি জান এবং মালের ক্ষয়-ক্ষতির হুমকি না থাকে।'

'আত্মরক্ষার্থে ফোর্স ব্যবহার করা যায়। আর যদি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় বা সম্ভাবনা থাকে, তখন দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করা যায়। এটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। জনগণের সভা-সমাবেশ এবং মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে, দেখতে হবে সেগুলো শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করছে কি-না,' যোগ করেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের এডিসি হারুন অর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার সময়ে কখনো কোনো আন্দোলনে পুলিশের ওপর হামলা এবং জনদুর্ভোগ ছাড়া আন্দোলনকারীদের ওপরে কখনো হামলা করা হয় নাই। যখন আইনশৃঙ্খলা বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড হয়, তখন নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।'

'ডিএমপি পুলিশের একটি বড় ইউনিট। এখানে আমি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। যা কিছুই হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে যেটা করার সেটিই করি। কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ ধরনের অভিযোগ করতে পারেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থে অবশ্যই পুলিশ কাজ করে,' বলেন তিনি।

এদিকে গতকাল শুক্রবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে গতকাল রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিল একদল চাকরিপ্রত্যাশী৷ অবরোধ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলছিল৷ এরপর পুলিশ এসে তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ সেখান থেকে সরে শাহবাগ থানামুখী রাস্তার দিকে এগোলে পুলিশ চাকরিপ্রত্যাশীদের কয়েকজনের ওপর লাঠিপেটা করে৷ এডিসি হারুনও লাঠিপেটা করে যুবকদের ধাওয়া দেন বলে জানান বিক্ষোভকারীরা৷

সেসময় ছবি তুলতে গেলে কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে এডিসি হারুন দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷

সাংবাদিকদের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীদের শাহবাগ মোড় থেকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার সময় ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করে এবং কয়েকজন সাংবাদিককে ধাক্কা দেয়৷

সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন অর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাংবাদিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার কোনো প্রশ্নই আসে না৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে তো পুলিশের কোনো বিরোধ নেই৷ এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না৷ ঘটনাস্থলে আমাদের ডিসি স্যার ছিলেন৷ ওনার নেতৃত্বে আমরা সমাবেশকারীদের সরিয়ে দিয়েছি৷'

Comments