লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম

চরে ভাঙা-গড়ার জীবন

কুড়িগ্রাম চরজীবন
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের বুকে পোরার চরের বাসিন্দা হোসনে আরা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

সোনাভান বেওয়ার বয়স ৯০ বছর ছাড়িয়েছে। চরের মাটিতে জন্মেছেন, চরেই বেড়ে উঠেছেন। বিয়েও হয়েছে চরে। স্বামী মোজা মিয়াকে হারিয়েছেন ২৫ বছর আগে। তাদের সংসারে ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে। ছেলেদের আলাদা আলাদা সংসার।

একেক ছেলের সংসার একেক চরে। এক চর থেকে আরেক চরে ছেলের বাড়িতে যেতে সোনাভানকে বেগ পেতে হয়। তবুও ছুটে যান তিনি। কখনো ভাত জোটে। কখনো অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়।

কুড়িগ্রাম চরজীবন
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের বুকে পোরার চরের বাসিন্দা আলী হোসেন ও তার পরিবার। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্গম পোরার চরের সোনাভান বেওয়ার অনেক কষ্ট। স্বামীর কবর বিলীন হয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। সে কথা মনে হলে চোখের পানি ফেলেন। বাবা-মা ও আত্মীয়দের কবরেরও কোনো চিহ্ন নেই।

চরে কবরের চিহ্ন না থাকা তাকে বেশি কষ্ট দেয়।

সোনাভান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জীবনে ১৭-১৮ বার বসতভিটা পরিবর্তন করেছি। এক চরে কিছুদিন থাকার পর অন্য চরে বসতি গড়তে হয়েছে। এভাবে চলছে জীবন। চরে বসতভিটা, আবাদি জমি হারাতে হয়েছে। চরে অনেক কষ্ট। তবুও চরের জীবনে মায়া লেগে আছে। তাই চর ছাড়তে ইচ্ছা করে না।'

চরে জন্মেছেন তাই চরে মরতে চান সোনাভান। নদী, নৌকা আর চর ছাড়া কিছুই দেখেননি। রেল গাড়ি ও বাসের নাম শুনেছেন। চোখে দেখা হয়নি। সারা জীবন শুধু চরেই চলাফেরা করেছেন। অধিকাংশ আত্মীয় চরেই থাকেন বলে জানান তিনি।

সোনাভান বেওয়ার ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৭০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরের জীবন খুব কষ্টের। তারপরও চর আশীর্বাদের মতো। চর ছাড়া অন্য কোথাও একদিনের জন্যও থাকতে পারবো না। চরে বন্যা, খরা ও নদীভাঙন লেগেই থাকে। বসতভিটা, আবাদি জমি হারাতে হয়।'

সোনাভান
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের বুকে পোরার চরের বাসিন্দা সোনাভান বেওয়া। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

'কিন্তু, বন্যার পর চরের জমিতে পলি জমে যে ফসল হয় তা দেখে প্রাণজুড়ে যায়। একবারের ফসল দিয়ে সারা বছর চলতে পারি। চরের জমিতে ফসল উৎপাদন করতে খরচ কম। ফসল ফলও অনেক বেশি। চরে জীবনযাপনের খরচ কম। সারাদিন কাজের মধ্যে কাটে। মাঝেমধ্যে নদীতে মাছ ধরি।'

জেলা প্রশাসন ও এনজিও সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর নদীর বুকে ৫২০টি চর রয়েছে। এসব চরে ৬ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। প্রতিটি চরে ১৫০-৩০০ পরিবার থাকে। কৃষি তাদের আয়ের প্রধান উৎস।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের বুকে দুর্গম চর দৈখাওয়ার মনসুর আলী (৫৮) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষিকাজ ও গবাদি পশু পালন করে আয় করি। সংসার চালানোর পর কিছু টাকা সঞ্চয় করি। তা খরচ হয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতের জন্য। অনেক সময় নদীভাঙনে ঘর সরিয়ে নিতে হয়। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে চরে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়।'

'তারপরও চরে ভালো আছি। চর ছাড়া অন্য কোথাও বসবাস আরও কষ্টের,' যোগ করেন তিনি।

কুড়িগ্রাম চরজীবন
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের বুকে পোরার চরে বন্যায় ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত করছেন আলী হোসেন। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তার বুকে চর হরিণচড়ার দিনমজুর মফিদুল ইসলাম (৫০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পরিবার–পরিজন নিয়ে শহরে গিয়েছিলাম। ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। রিকশা চালিয়েছিলাম ২ মাস। কিন্তু, থাকতে পারিনি। সবাইকে নিয়ে আবারো চরে চলে এসেছি।'

তার মতে, 'চরে বন্যা, খরা, ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। চরের মানুষের কোনো সম্পদ নেই। কিন্তু, তারা সুখী। কারণ, তাদের তেমন কোনো অসুখ নেই। বর্তমানে চরে গবাদিপশু পালন করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন।'

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার এনজিও প্রতিনিধি আহসানুল কবীর বুলু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরের অনেক মানুষকে একাধিকবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল মূল-ভূখণ্ডে বসবাসের জন্য। তাদেরকে সার্বিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কেউই রাজি হননি।'

'আসলে চরের অনেকে মূল-ভূখণ্ডে এসে মানিয়ে নিতে পারেন না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'তারা যে সব কাজে অভ্যস্ত মূল-ভূখণ্ডে সেসব কাজের সুযোগ কম। চরের মানুষকে চরে রেখেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতন করতে হবে। তাদেরকে সঞ্চয় করতে শেখাতে হবে। দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi Migrant Workers Deaths Over The Years

In coffins, from faraway lands

Kazi Salauddin, a 44-year-old man from Cumilla, migrated to Saudi Arabia in October 2022, hoping to secure a bright future for his family. But barely a year later, Salauddin, the father of two daughters and a son, died suddenly.

9h ago