ঋণের দুষ্টুচক্রে বন্দি ১৪ হাজার জেলে পরিবারের ভাগ্য

ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন ৬৮ বছর বয়সী জালকু চন্দ্র দাস। ৮ বছর বয়স থেকে তিনি তার বাবা শিয়ালু চন্দ্র দাসের সঙ্গে মাছ ধরা শুরু করেন।
বছর শেষে জাল মেরামত করতে ঋণ নিতে হয় জেলেদের। ঋণের সেই টাকা পরিশোধ করতে হয় পরের বছরটি জুড়ে। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন ৬৮ বছর বয়সী জালকু চন্দ্র দাস। ৮ বছর বয়স থেকে তিনি তার বাবা শিয়ালু চন্দ্র দাসের সঙ্গে মাছ ধরা শুরু করেন।

অক্ষরজ্ঞানহীন এই মানুষটি জরুরি প্রয়োজনে টিপসই ব্যবহার করেন। মেয়ে ও ২ ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরাও ব্রহ্মপুত্রে মাছ শিকার করে জীবিকা চালাচ্ছেন। সবাই যে যার সংসারে ব্যস্ত।

জালকু দাস তার স্ত্রী সুখি বালা দাসকে (৬৪) নিয়ে বসবাস করেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া মাঝিপাড়া গ্রামে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া এই জেলে জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেলেও তার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তার মতোই পরিস্থিতি এই গ্রামের ১২০টি জেলে পরিবারের।

ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরা শেখে জেলে পরিবারে সন্তানরা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয় থেকে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে ১২০টি জেলে পাড়ায় ১৪ হাজার জেলে পরিবার বসবাস। তাদের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার পরিবার লালমনিরহাটে এবং সাড়ে ১০ হাজার পরিবার কুড়িগ্রামের।

জালকু চন্দ্র দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার নিজের নৌকা নেই। অন্যের নৌকা নিয়ে মাছ ধরি। সারা বছরের আয় থেকে খেয়ে না খেয়ে যেটুকু টাকা জমাই, সেটা বছর শেষে জাল মেরামত করতে এবং কিনতে খরচ হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে মাছ ধরতে যেতে না পারলে, অন্যের কাছে ধার করে চলতে হয়।'

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ শতাংশ জমিতে জালকু দাসের ২টি ঘর রয়েছে। একটি রান্না ঘর, অপরটি থাকার।

তিনি বলেন, 'আমাদের গ্রামের কোনো জেলে পরিবারের ভাগ্যের কোনো ধরনের পরিবর্তন নেই। ২ যুগ আগেও আমরা যেমন দুর্ভাগা ছিলাম, এখনো তাই আছি।'

একই ভাষ্য কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জোরড়াছ মাঝিপাড়া গ্রামের বিষাদু চন্দ্র দাসের (৮০)। তিনি বলেন, 'মাছ ধরে আমি এবং আমার ছেলেরা কিছুই করতে পারিনি। শুধু দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছি। বড় কোনো সমস্যায় পড়লে ঋণ করতে হয়। সেই ঋণে টাকা শোধ করতে করতেই আয়ের বেশিরভাগ টাকা শেষ হয়ে যায়।'

বিষাদুর ছেলে রজনীকান্ত দাস (৫২) বলেন, 'নদ-নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যে মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো বিক্রি করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বছর শেষে নৌকা ও জাল মেরামত করতে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। তারপর প্রায় সারা বছর ধরে সেই ঋণের ঘানি টানতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'সন্তানদের পড়াশুনা শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করতে পারছি না। বরং সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরি, তাদেরকে মাছ ধরার কৌশল শেখাই।'

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের সারথী রানী দাস (৪৫) বলেন, 'ক্ষুধা নিবারণ করতেই আয়ের অধিকাংশ টাকা ব্যয় হয়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক পর্যন্ত পড়ে। অল্প কিছু ছেলে-মেয়ে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশুনা করে। কলেজে খুব বেশি কেউ পড়তে পারে না। তার আগেই কাজে নেমে যেতে হয়।'

তিনি জানান, মাঝিপাড়া গ্রামের প্রায় ২৫০টি পরিবারের মধ্যে ৩-৪ জন ছেলে-মেয়ে কলেজে পড়ে।

তিনি বলেন, 'বিপদে পড়েই আমাদেরকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বাঁচতে হয়। ঋণের দুষ্টচক্র থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না।'

একই গ্রামের সুবল চন্দ্র দাস (৫০) বলেন, 'আমাদের সমিতি আছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই সমিতি ব্যবহার করে সরকারের জলাশয় লিজ নেন। আমরা জেলেরা এর থেকে কোনো সুবিধা পাই না। যারা লিজ নেন তাদের কাছে দিন হাজিরা দিয়ে মাছ ধরি।'

তিনি বলেন, 'যদি সরকারি জলাশয়গুলো লিজ নিতে পারতাম, তাহলে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতো। আমাদের তো আর সরকারি জলাশয় লিজ নেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়ে প্রভাবশালীদের দ্বারস্থ হতে হয়।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তাপাড়ে সারপুকুর দাসপাড়া গ্রামের অনিল চন্দ্র দাস (৬০) বলেন, 'সম্প্রতি অনেক জেলে মাছ ধরা বাদ দিয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। প্রতি বছর নৌকা ও জাল মেরামত করতে অথবা কিনতে অনেক টাকা খরচ হয়। এ কারণে অনেক জেলে বাধ্য হয়েই চড়া সুদে ঋণ নেন। জেলেদের জীবন দিন দিন আরও বেশি দুর্বিসহ হচ্ছে।'

পরিবারের আর্থিক চাপ সামলাতে গিয়ে ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার কাজ শুরু করে দেয় জেলে পরিবারের সন্তানরা। এতে করে তাদের পড়াশুনা উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয় না। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার এনজিও প্রতিনিধি আহসানুল কবীর বুলু বলেন, 'ব্রহ্মপুত্র পাড়ের জেলেদের ১ যুগ আগে যে অবস্থায় দেখেছি, এখনো একই তেমনই দেখি। জেলেরা তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করানোর চেয়ে মাছ ধরা শেখাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, একটু বড় হওয়ার পর তারা মাছ ধরতে গেলে পরিবারে বাড়তি কিছু অর্থ আয় হবে।

তিনি আরও বলেন, 'নগদ টাকা না নিয়ে চুক্তিতে জেলেদের সরকারি জলাশয় লিজ দেওয়া গেলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে।'

কুড়িগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালীপদ রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলে পরিবারগুলোর সন্তানরা একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের উন্নতি হওয়া কঠিন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের অনেক জেলে পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তবে, তারা ঋণের টাকা শোধ করতেই বিপাকে পড়ে যান।'

তিনি বলেন, 'জেলে পরিবারের সন্তানরা যাতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সে বিষয়ে আমরা প্রচারনা চালাচ্ছি।'

জেলেদের সহজ শর্তে জলাশয় লিজ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'সরকারি জলাশয় ভূমি মন্ত্রণালয় লিজ দেয়। আমরা শুধু মৎস্যজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে দেই। জলাশয় মৎস্যজীবীদের নামেই লিজ দেওয়া হয়। কিন্তু জেলেদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় প্রভাবশালীরাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

57m ago