সংস্কারের অভাবে বসবাসের অনুপযোগী আবাসন প্রকল্পের ঘর

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিডরসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারানো হতদরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
কিছু ঘরের বেড়া-টিন উধাও হয়ে গেছে। ছবি: স্টার

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিডরসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারানো হতদরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এসব ঘরের টিন-চাল-বেড়া উধাও হয়ে যাচ্ছে। তদারকির অভাবে জীর্ণদশার কারণে এসব ঘরে আশ্রিত পরিবারগুলো অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে পাশের বেড়িবাঁধের স্লোপে কিংবা খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘরে চরম ঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছেন। ফলে আশ্রয়হারা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আর পুনর্বাসনের এসব ঘর খালি পড়ে আছে।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ১২ হাজার ৯০০ পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়ে। তখন এসব পরিবারকে আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারি ও দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নে ১৭০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। যেখানে প্রায় ২ হাজার পরিবারের আশ্রয় নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে আরও ৫ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

ব্যারাকের কক্ষে রাখা হয় গবাদি পশু। ছবি: স্টার

২০০৭ সালের সিডর পরবর্তী সময় থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনের কাজ চলে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে অধিকাংশ ঘরের টিনের চাল উড়ে যায়। রাতের আধারে অনেক ঘরের বেড়া-চাল খুলে নিয়ে গেছে। এসব আবাসনে বসবাসকারী একেকজন একাধিক ঘর দখল করে গবাদিপশুও পালন করছেন। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার ছিন্নমূল মানুষকে আশ্রয়স্থল করে দিলেও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। শুধু আশ্রয় নয়, আয় বর্ধক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষভাবে গড়ে তুলে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়াও চালু করা হয়।

উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরি বুনিয়া এলাকায় ২০০৮ সালে ১০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১০টি টিনশেড ব্যারাক করে দেওয়া হয়। মনোরম পরিবেশ। ইউ টাইপে তিনদিকে ব্যারাক হাউস। মাঝখানে একটি বিশাল পুকুর। দক্ষিণ দিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার। যেখানে আবাসনে বসবাসকারীদের শিশুরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে। পুকুরটিতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা। কিন্তু সবকিছুর বেহালদশা।

১০ নম্বর ব্যারাকের ৭ নম্বর কক্ষে বসবাসকারী সালমা ও বাদল হাওলাদার দম্পতি জানান, ঘরগুলো জরাজীর্ণ হওয়ার কারণে এখন এখানে থাকার উপায় নেই। চাল উড়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে। একই ব্যারাকের ৪টি কক্ষ বর্তমানে খালি পড়ে আছে।

৭ নম্বর ব্যারাকের ৯ নম্বর কক্ষে থাকছেন রাবেয়া-আলফাজ দম্পতি। তাদের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ থাকলেও তারা থাকছেন ৩টি কক্ষ দখল করে। ৬ নম্বর ব্যারাকের ৮টি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেড়ার টিন উধাও হয়ে গেছে। এই ব্যারাকের ৩টি কক্ষে এখন গবাদি পশু রাখা হয়। ৫ নম্বর ব্যারাকের ১০টি কক্ষের ৪টি খালি পড়ে আছে। এভাবে এখানকার ১০টি ব্যারাকের ১০০ কক্ষের অন্তত ৬০টি খালি পড়ে আছে।

একই অবস্থা চর ধুলাসারের ২টি ব্যারাকের ২০টি কক্ষের অর্ধেক খালি। চরচাপলীর ৩টি ব্যারাকের ৩০টি কক্ষের ২১টি খালি পড়ে আছে। একটি ব্যারাকের চাল-বেড়া খুলে নেওয়া হয়েছে। ব্যারাকের টিন চাল জীর্ণদশায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। লোহার এ্যাঙ্গেলগুলো ভেঙ্গে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ছে। টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। মেলাপাড়া গ্রামের আবাসনটি নদীরপাড়ে হওয়ায় জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়।

সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নীলগঞ্জ নদীর পাড়ে। এখানে ২৮টি ব্যারাকে ২৮০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। কলাপাড়া শহরের উল্টোদিকে হওয়ায় এখানে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী মানুষ বাস করছে। এসব পরিবারের সদস্যদের সমবায়ের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। কিন্তু কোনটাই সফলতা পায়নি। ঘরগুলো জীর্ণ হয়ে গেছে। যাদেরকে ঘর দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকে আবার অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে।

সবচেয়ে বেশি বেহাল দশা চালিতা বুনিয়া আবাসনের। এখানে ১০টি ব্যারাকের ১০০ কক্ষের মধ্যে ৯১টি খালি। খালি ঘরগুলো গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে। বেড়ার টিন লাপাত্তা। সংযোগ সড়ক নেই। টয়লেটগুলো ভেঙ্গে গেছে। একটিমাত্র টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে।

এছাড়াও সিডর পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকারের সহায়তায় ১ হাজার ৫৪০টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ব্রিটিশ রেডক্রিসেন্ট ৭৫২টি, স্পিড ট্রাস্ট ১ হাজার, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ৬০০, সোশ্যাল এসিসট্যান্স ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ৪৫টি, উরমাতা বাংলাদেশ ৯৪টি, ব্র্যাক ৩০টি, লায়ন্স ক্লাব ৩০টি, গ্রুপ থিয়েটার বাংলাদেশ ২০টি, অরকা রাজশাহী ৮০টি, ফ্রেন্ডশিপ ৪৯টি, কারিতাস ৬০০টি, স্পিড ট্রাস্ট (একশন এইড) ৮৪টি, প্রথম আলো একটি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়। কিন্তু সংস্কারের অভাবে এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক জানান, ওইসব আবাসন-আশ্রয়ণ ঘরগুলো মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রত্যেক গৃহহীন-ভূমিহীনকে ২ শতাংশ জমিসহ আলাদাভাবে সেমিপাকা ঘর দিচ্ছেন। সব গৃহহীন এখন ঘর পাচ্ছেন।

Comments