পুলিশের হাতে নির্যাতন: মামলার পর হুমকির অভিযোগ, বিচার নিয়ে শঙ্কা

পুলিশের হাতে নির্যাতন: মামলার পর হুমকির অভিযোগ, বিচার নিয়ে শঙ্কা
রাজীব কর রাজু। ছবি: সংগৃহীত

৩ বছর আগে একটি ভয়াল রাত তার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কোতোয়ালি থানার ২ কর্মকর্তা সাদা পোশাকে রাজধানীর গোয়ালনগর এলাকায় জুয়েলারি-দোকানের কর্মী রাজীব কর রাজুর বাড়িতে যান।

তারা ১১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা মূল্যের ২৮ তোলা স্বর্ণালঙ্কার এবং রাজীবের মায়ের চিকিৎসার জন্য সঞ্চয় করা নগদ ৪১ হাজার ৩০০ টাকা নিয়ে যান। এরপর রাজীবকে মারধর করে হাতকড়া পরিয়ে মোটরসাইকেলে করে থানায় নিয়ে যান।

বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সদর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপির অভিযোগ মনিটরিং সেলে এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, 'থানায় ৩ পুলিশ সদস্য কোনো মায়াদয়া ছাড়াই আমাকে প্রচণ্ড মারধর করেন। তাদের একজন আমার আঙুলের নখ তুলে ফেলেন। পরে তারা আমার মুক্তির জন্য ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। আমি ২ লাখ টাকা দিয়ে বেরিয়ে আসি।'

ভয়াবহ এই পুলিশি নির্যাতনের শিকার রাজীব আশা করেছিলেন তিনি ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি লুট করা সোনা বা টাকা ফেরত পাননি। ন্যায়বিচার এখন তার কাছে দুষ্প্রাপ্য বলে মনে হচ্ছে।

কয়েকবার চেষ্টার পর গত ২ মার্চ ঢাকার আদালতে ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন তিনি।

অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন উপ-পরিদর্শক মিজানুর রহমান (৪০), সহকারী এসআই ফরিদ ভূঁইয়া (৩৫) ও এসআই জলিল (৩৫)।

গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'কিন্তু মামলা করার পর থেকে আমি নতুন সমস্যায় পড়ি।'

এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তাকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

গত ৩ বছরের ধরে এই ঘটনায় বিচার চাইতে গিয়ে রাজীব যেন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হলেন।

ভয়াল রাত

সেই রাতের কথা মনে করে রাজিব বলেন, 'আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ আমাকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করেন।'

নির্যাতন সইতে না পেরে কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারান তিনি।

'পরে এএসআই ফরিদ ও এসআই জলিল আমাকে আবারও নির্যাতন করে। আমাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারা আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসা শেষে আবার নিয়ে যায় থানায়। তারপর বাসায় ফোন করার জন্য তারা আমার ফোন ফিরিয়ে দেয়।'

২ লাখ টাকা দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। অ্যাকাউন্টের টাকা লেনদেন স্লিপ এখনও তার কাছে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

কেন পুলিশ তাকে টার্গেট করেছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত নন রাজীব।

'মামলা করার পর পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আমি নাকি একজন ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে সোনা ছিনিয়ে নিয়েছি। এইজন্য তারা আমাকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত কোনো ভুক্তভোগীকে আমার সামনে হাজির করতে পারেননি,' বলেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করার পর, একজন সহকারী পুলিশ সুপার ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে কিছু সময় ঘটনাটি তদন্ত করেছিলেন। কিন্তু রাজীবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি।

রাজিব বলেন, 'বিষয়টি গোপনীয় উল্লেখ করে, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ওই ৩ জনকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যন্ত জেলায় স্থানান্তর করা হয়েছে।' এই ধরনের গুরুতর অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে জানার পর হতাশা জানান তিনি। বলেন, 'তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আমার ক্ষতিপূরণ কোথায়?' তিনি আমাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন।'

রাজীব জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে বিষয়টি জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরেরকে অনুরোধ করে।

এখন পর্যন্ত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৫ বার পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

১৯ আগস্ট এক চিঠিতে মানবাধিকার কমিশন এটিকে 'দুর্ভাগ্যজনক' বলে উল্লেখ করেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মনে করে এতে ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।'

সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল শুনানিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শফিকুল ইসলাম জানান, এই ধরনের অভিযোগ সমাধানের জন্য তারা একটি পৃথক সেল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মামলা করার পর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন আদালত। ১৮ মে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতালের রেজিস্ট্রার বইতে প্রমাণ আছে যে, রাজীবকে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাকে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।

ওই দিনই ইনজুরি সার্টিফিকেট দেয় হাসপাতাল। নথি অনুসারে, রাজীবের উপরের ও নিচের ঠোঁটে, ডানদিকের তর্জনী এবং অনামিকাতে আঘাত ছিল। তার পিঠে ও উভয় বাহুতে আঘাতে কালচে দাগ ছিল।

রাজীব জানান, ঢাকার একটি আদালতে মামলা করার পর, পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে ৩ জন তাকে ফোন করেন এবং মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেন।

ঘটনার বিষয়ে জানতে এসআই মিজানকে ফোন করা হলে প্রশ্ন শোনার পর তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি। এসআই জলিলও ফোন ধরেননি। এএসআই ফরিদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে মামলাটি তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো-উত্তর) কুতুবুর রহমান চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সাক্ষীদের বক্তব্য এবং মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহ করছেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার এখনো কথা হয়নি বলেও জানান তিনি।

'যদি জানতাম পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর আমাকে এতো ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তাহলে আমি মামলা করতাম না,' রাজীব হতাশার সুরে বলেন।

'এখন ভবিষ্যত নিয়ে ভয় পাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

9h ago