তারা যেভাবে ‘ছুটিবঞ্চিত’
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/very_big_201/public/images/2022/10/07/cover_ill.png?itok=g1SK8O_4×tamp=1665138309)
উৎসবে ছুটি পাওয়া আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক। এমন দিনগুলোতে পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন সবাই।
তবে, অনেককেই এই বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে হয়। বিভিন্ন ধর্ম ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বঞ্চিত হন তাদের ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত উৎসবের ছুটি থেকে।
মনিপুর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৫ বছর বয়সী রূপন্তী সাহা (ছদ্মনাম)। অনেক ধর্মীয় উৎসবে সে ছুটি পায় না। দুর্গাপূজায় ছুটি পেলেও তার পরিবার পালন করে এমন অনেক ধর্মীয় উৎসবে তার ছুটি নেই। সেসব উৎসব পালন করতে হলে তাকে স্কুল থেকে ছুটি নিতে হয়।
সেই ছুটিও কোনো সহজ বিষয় না। মাসে ৩ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার স্কুলে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়।
রূপন্তী বলে, '৩ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে জরিমানা ১ হাজার ৬০০ টাকা। আমার এক মাসের বেতনও প্রায় এই পরিমাণ টাকাই আসে। ফলে, বেশ কিছু ধর্মীয় উৎসবের সময় আমি গ্রামে যেতে পারি না৷'
'স্কুলে আবেদন জমা দিলেও কাজ হয় না। কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার অভাবে প্রায়ই জরিমানা মওকুফ করা হয় না', যোগ করে রূপন্তী।
একই অবস্থা রূপন্তীর মতো হাজারো শিক্ষার্থীর। ২৫ বছর বয়সী অদ্রিজিৎ দেব জানান পূজা ও দীপাবলির দিনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পড়ার অভিজ্ঞতা।
তিনি বলেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সুযোগ। উৎসবের সময়ও আমাকে এই পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই উদযাপন আর করতে পারিনি। এটা সত্যিই খুব হতাশার। বছর শেষে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে উদযাপনের এমন বিশেষ দিনে পরীক্ষা, পড়াশোনা কার ভালো লাগবে বলুন।'
অদ্রিজিৎ জানান, তার বাবা চিকিৎসক। বছরে তার বিভাগীয় ছুটি ছিল ৩ দিন— দুর্গাপূজা, দীপাবলি ও সরস্বতী পূজায় ১ দিন করে। এর অর্থ, তিনি উৎসবের পুরোটা সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারতেন না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সময় অদ্রিজিতের বোনকেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। অদ্রিজিৎ বলেন, 'আমার বোন, তার স্বামী বা তাদের পরিবার, কারো কাছেই এটা ভালো লাগে না। কারণ আমার বোনের ডিউটি শিফট শেষ হওয়ার পরই কেবল সবাই তার সঙ্গে কোথাও যেতে পারে।'
তিনি জানান, ২ ঈদের ছুটিতেও তাকে হাসপাতালে কাজ করতে হয়েছে। সেই সময়টি ছিল আরও কঠিন। কারণ, ঈদের ছুটির সময় হাসপাতালে কর্মীসংখ্যা খুবই কম থাকে।
অদ্রিজিৎ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে তার প্রাপ্য ছুটি পেয়েছেন। তবে, সবাই এতটা ভাগ্যবান না।
ক্রিস্টিনা জয়িতা মুন্সি খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। তিনি একটি বেসরকারি নীতি গবেষণা সংস্থায় জুনিয়র বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন। একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে তার ছুটি চাওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ হতাশাজনক।
একটি বিশেষ ঘটনার কথা স্মরণ করে ক্রিস্টিনা বলেন, 'আমি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করতাম। একবার আমাকে বড়দিনের আগের দিন ২৪ ডিসেম্বর একটি সংবাদ কাভার করতে দিলো। এমনকি বড়দিনের পরের দিন ২৬ ডিসেম্বর একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য অফিসে আসতে বললো। অথচ, এই ২ দিনই আমি ছুটি নিয়েছিলাম।'
তিনি বলেন, 'বড়দিনের আয়োজনে ব্যাপ্তি অনেক বড়। একাধিক দিক যেমন গির্জা, নিজের ঘর সাজাতে হয়, পরিবারের সঙ্গে সময় দিতে হয়, অপরদিকে কেক, পিঠা তৈরি করা, প্রিয়জনদের জন্য উপহারের ব্যবস্থা করতে হয়। সেইসঙ্গে আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি তো আছেই। এত কিছুর জন্য মাত্র একদিনের ছুটি পেলে কী করতে পারবেন? অথচ, এই দিনটির জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকি।'
ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মতো একই সমস্যায় পড়েন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র ২৩ বছর বয়সী আন্তন চাকমার কাছে তার পরিবারের সঙ্গে চাকমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব বিজু উদযাপন করা যেন স্বপ্নের মতো।
এ বছর বিজু উদযাপনের সময় তার পরীক্ষা না থাকলেও, তিনি দেখেছেন তার অনেক জুনিয়র, যারা চাকমা গোষ্ঠীর, সেই সপ্তাহে পরীক্ষা থাকায় বিজু উৎসবে যোগ দিতে পারছে না। বিজুর আগের দিন তার এক জুনিয়র তাকে ডেকে বলেছিলেন, 'দাদা, আমি এবার বাড়ি যেতে পারছি না। আপনি যাচ্ছেন?'
এমন পরিস্থিতি আন্তনের জন্য হতাশাজনক। তিনি বাড়ি না গিয়ে ঢাকাতেই পরিবার, বন্ধু ও জুনিয়রদের সঙ্গে বিজু উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আরও অনেক বন্ধুর মতোই বিজু উৎসবের বেশকিছু ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি পালন করতে পারেননি আন্তন।
আন্তন আরও বলেন, 'এই সমস্যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই না, আমার বোনসহ স্কুল ও কলেজে যারা পড়ে, তাদেরকেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সাধারণত প্রতি বছরের বিজু উৎসবের সময় ক্লাস কিংবা পরীক্ষা থাকে।'
স্কুলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা উঠে আসে মে'র (ছদ্মনাম) কথাতেই। ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ১৭ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী রাখাইন বংশোদ্ভূত এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বছরে সে ৩টি ধর্মীয় উৎসব পালন করে— সাংগ্রাই, বুদ্ধ পূর্ণিমা ও প্রবারোনা পূর্ণিমা।
বুদ্ধ পূর্ণিমা ও সাংগ্রাইয়ের জন্য ১ দিন করে ছুটি পেলেও প্রবারোনা পূর্ণিমায় ছুটি পায় না সে। অথচ, কক্সবাজারে তার সম্প্রদায়ের মানুষ সপ্তাহব্যাপী রাখাইন ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল ও প্রবারোনা পূর্ণিমা পালন করে।
মে বলে, 'উত্সবগুলো চলে প্রায় সপ্তাহব্যাপী। অনেক বড় আয়োজন, অনেক সুন্দর। কিন্তু আমি যেতে পারি না। বাবা-মায়ের কাছে শুনে বড় হয়েছি এসব আয়োজন সম্পর্কে।'
মে জানায়, ছুটির অভাবে নিজ বাড়িতে, নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে এসব উত্সব উদযাপন করতে না পেরে সবার থেকে সে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে উঠছে।
মে আরও বলে, 'আমি এখনো আমাদের সব আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ভালোভাবে জানি না। কারণ সময়ের অভাবে এসব উৎসবেও যোগ দিতে পারি না, আর আলোচনাও করতে পারি না।'
দেশের সংখ্যালঘুদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি এনসিটিবি'র বাংলা বইয়ে দেশের বৈচিত্র্যের একটি অধ্যায়েই যেন সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর বাইরে বের হয়ে সত্যিকার অর্থে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর শুরু হতে পারে তাদের উৎসবে ছুটি নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
অনুবাদ করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস
Comments