এমপির সাগর ‘ইজারা বাণিজ্য’

পটুয়াখালীতে বঙ্গোপসাগরের মোহনা-চর মৌখিকভাবে ইজারা দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ
পটুয়াখালী সাগর
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর মোহনায় বুড়াগৌড়াঙ্গ নদীর মুখে মাছ শিকারে সাগরে খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের কাছে নদীর মোহনা ও চরগুলোয় মাছ ধরার জন্য মৌখিকভাবে ইজারা দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমানের বিরুদ্ধে।

জেলেদের অভিযোগ, সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন টাকার বিনিময়ে এসব চর ইজারা দেন। এমপি মহিব্বুর রহমানের নাম করে চরগুলোয় মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়।

চরগুলো হলো—কুয়াকাটার সৈকতের কাছে চর বিজয়, হাইয়ের চর, গঙ্গামতি সৈকতের মোহনা, বুড়াগৌরাঙ্গা নদীর মোহনা, রামনাবাদ নদীর মোহনাসহ রাঙ্গাবালী উপজেলার চর হেয়ার, সোনারচর, মেছের চর, জাহাজমারা চর, চরমোন্তাজ ও তুফানিয়া চর।

এসব চরে জেলেরা কারেন্ট জালের ঘের (স্থানীয় ভাষায় খুঁটা জাল) দিয়ে মাছ ধরেন।

মহিব্বুর রহমান সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই এ ধরনের 'সাগর বাণিজ্য' শুরু হয়েছে বলেও দাবি জেলেদের।

মহিব্বুর রহমান
সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

এমপির ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে রাঙ্গাবালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান মামুন, কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউনুস জালাল, একই ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিন্টু ভূঁইয়া, রাঙ্গাবালীর বাবু তালুকদার ও শাহজুল মীর স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

চর হেয়ারে মাছ ধরতে আসা এক জেলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই চরে মাছ ধরতে এক বছরের জন্য শাহজুল মীরকে প্রায় ৯০ হাজার টাকা দিয়েছি।'

জেলেদের মধ্যে চরটি ভাগ করে শাহজুল ৭-৮ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

একই অভিযোগ স্থানীয় জেলেদের।

তারা ডেইলি স্টারকে জানান, শাহজুল ৬ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য এমপির কাছ থেকে মৌখিক ইজারা নিয়েছে। এ বছর প্রত্যেক জেলের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে সেখানে মাছ ধরার সুযোগ করে দিচ্ছে।

স্থানীয় জেলে তোতা মৃধা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমপি মৌখিকভাবে রাঙ্গাবালীর বাবু তালুকদারকে ইজারা দিয়েছেন। বাবুর কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন শাহজুল মীর। তিনি প্রথম বছর ৩৫ হাজার টাকা এবং পরের বছর ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। এই বছর আমরা শাহজুল মীরের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকায় লিজ নিয়েছি।'

অভিযোগের বিষয়ে শাহজুল মীর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই জেলেদের কাছে আমি ২-৩ মাস আগে কিছু মাছ চেয়েছিলাম। আমার কাছে মাছ বিক্রি করতে বলেছিলাম। কিন্তু, ওরা বিক্রি করেনি। সাংবাদিকদের কাছে ওরা মিথ্যা বলছে।'

রাঙ্গাবালীর সোনারচর সংলগ্ন মেছের চরের এক জেলে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ চরে ১২ জেলে মাছ ধরার জন্য ২ লাখ টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামানের কাছ থেকে মৌখিক ইজারা নিয়েছেন।'

অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান খান মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর বা সাগর ইজারার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।'

জেলেদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাঙ্গাবালীর বাবু তালুকদারও।

কলাপাড়ার ধুলাসার ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল মাস্টারের অভিযোগ, ধুলাসার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিন্টু ভূঁইয়াও জেলেদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চর ইজারা দেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে নদীগুলোর মোহনাসহ যত চর আছে, সবই মৌখিকভাবে "ইজারা" দেওয়া হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সমুদ্র ও নদীর সংযোগস্থল রামনাবাদ চ্যানেল থেকে সমুদ্রের "মালোর ট্যাক" পর্যন্ত প্রতি বছর ২৬ লাখ টাকায় "ইজারা" দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। বিষয়টি তদারকি করেন ধুলাসার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিন্টু ভূঁইয়া। এ ছাড়া চর বিজয়ও এ বছর ৪ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।'

অভিযোগ অস্বীকার করে মিন্টু ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। এমপি সাহেব এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।'

ধুলাসার ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আনোয়ার ফকির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগরে মাছ ধরার জন্য জেলেদের কাছ থেকে নানান উপায়ে টাকা আদায় করা হয়। পার্টির খরচসহ নানান অজুহাতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউনুস জালালসহ অন্য নেতারা টাকা নেন। টাকা না দিলে মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। এমপি সাহেবের ইশারা ছাড়া তো আর এসব হয় না। ইউনুস-জালালদের কী এত ক্ষমতা আছে!'

ধুলাসার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউনুস জালালকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাশফাকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগর কিংবা চর ইজারা দেওয়ার সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'জাহাজমারা চরে নদীর মোহনায় জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে এমন খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে সেখানকার জাল সরানো হয়েছে।'

কলাপাড়ার ইউএনও শংকর চন্দ্র বৈদ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর বা নদীর মোহনা ইজারা দেওয়ার সুযোগ নেই। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগর সংলগ্ন নদীর মোহনা বা চর "ইজারা" দেওয়ার ঘটনা আমার জানা নেই। কে বা কারা ইজারা দিচ্ছে, তা জানি না। এসব কাজে আমার সম্পৃক্ততা নেই।'

'যারা এসব কাজে জড়িত খোঁজ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আমার সুনাম নষ্ট করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এসব রটাচ্ছে।'

সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'সাগর সংলগ্ন নদীর মোহনা বা চর 'ইজারা' দেয়ার ঘটনা আমার জানা নেই। কে বা কারা ইজারা দিচ্ছে, তা জানি না। এসব কাজে আমার সম্পৃক্ততা নেই। যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা আমাদের দলীয় লোকজন। দলীয় কর্মকাণ্ডে আমার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা থাকলেও জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে যারা এসব কাজে জড়িত খোঁজ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমার সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন এসব রটাচ্ছে।'

এদিকে, আজ দুপুরে কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, 'সংসদ সদস্যের সুনাম ক্ষুন্ন করতে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মহল আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করতে কাজ করছে আর তারই অংশ হিসেবে এসব মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Can't afford another lost decade for education

Whenever the issue of education surfaces in Bangladesh, policymakers across the political spectrum tend to strike a familiar chord. "Education is our top priority," they harp

3h ago