‘নারী জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা নেই, আছে শুধু চেয়ার’

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী জনপ্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। অনেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও পরিষদ থেকে নিয়মিত অর্থ বরাদ্ধ পান না। স্থানীয় পর্যায়ে তারা কাজ করার সুযোগ পান না।
খুলনা
খুলনায় 'স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ: বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ইউএনডিপি। ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী জনপ্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। অনেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও পরিষদ থেকে নিয়মিত অর্থ বরাদ্ধ পান না। স্থানীয় পর্যায়ে তারা কাজ করার সুযোগ পান না।

এমনকি অনেক পরিষদের চেয়ারম্যান তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। নারী জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।

বুধবার দুপুরে খুলনা জেলার নারী জনপ্রতিনিধি সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন বিভিন্ন স্তরের নারী জনপ্রতিনিধিরা।

'স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ: বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ করণীয়' বিষয়ক এ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ইউএনডিপি।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরাঘোনা ইউনিয়ন পরিষদে নারী সংরক্ষিত সদস্য পদে নির্বাচিত ট্রান্সজেন্ডার শাহিদা বিবি বলেন, 'এক বছর হয়েছে, আমি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছি। এরমধ্যে মাত্র তিন মাসের ভাতা পেয়েছি।'

'আমি নির্বাচনে তিনটি ওয়ার্ড থেকে যে সংখ্যক ভোট পেয়েছিলাম, চেয়ারম্যান ৯টি ওয়ার্ড থেকেও সেই সংখ্যক ভোট পাননি। অথচ চেয়ারম্যানের কাছে ভাতার টাকা চাইতে গেলে বলেন কোনো টাকা নেই,' বলেন শাহিদা।

'চেয়্যারম্যানরা নারীদের মূল্যায়ন করেন না। তারা হলেন পরিষদের সর্বক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ একটি ওয়ার্ডের পুরুষ মেম্বারকে ভিজিপি চালের জন্য যদি ১০০টি কার্ড দেওয়া হয়। সেখানে আমি তিনটি ওয়ার্ডের মেম্বার, আমাকে দেওয়া হয় মাত্র ৩০টি। এই বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছেন চেয়ারম্যানরা। আমাদের বৈষম্য নিয়ে আমি স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছেও গিয়েছি। তিনি শুনেছেন, তবে কোনো প্রতিকার করেননি, বলে জানান শাহিদা।

তিনি আরও বলেন, 'সরকার বিভিন্ন সময়ে পরিষদে নানা রকমের বরাদ্দ দেন। অধিকাংশ পরিষদের চেয়াম্যানরা নিজেদের ইচ্ছামত সেই বরাদ্দ খরচ করেন। নারী জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনাও করেন না।'

সম্মেলনে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমীনা পারভীন রুমা বলেন, 'নির্বাচিত হওয়ার পরে আমি উপজেলা পরিষদে শুধুমাত্র বসার জন্য একটি চেয়ার ও টেবিল পেয়েছি। আমি নিজেই জানি না আমার কাজ কী! আমার নামে কোনো অর্থ বরাদ্দ হয় না। পরিষদ থেকে নারী উন্নয়ন ফোরামের নামে ৩ শতাংশ বরাদ্দের কথা বললেও, চেয়ারম্যানরা আমাকে তা দেন না। এমনকি জনসেবা করার জন্য আমার কতটুকু কী করার আছে আছে, তাও জানি না। নারীরা শুধুমাত্র নামেই নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কাজ করতে দেওয়া হয় না।'

সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার। তিনি বলেন, 'পরিষদে কোনো অনিয়ম হলে আপনারা তাৎক্ষণিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানান। তিনি ব্যবস্থা না নিলে সরাসরি আমাকে জানান। আমার কাছে আসতে না পারলে মোবাইল ফোনে জানান। আমি ব্যবস্থা নেব।'

ডিস্ট্রিক ফ্যাসিলেটেটর, ইএলজি (ইফিসিয়েন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টটেবিল লোকাল গভর্নেন্স) মো. ইকবাল হাসান জানান, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে স্থানীয় নারীর অংশগ্রহণ সংরক্ষিত থাকলেও তাদের যথাযথ ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন, ৩২৮টি পৌরসভা, ৪,৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদ এবং ৬১টি জেলা পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন সংরক্ষিত আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ১৮ হাজার নারী জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করছেন, যারা অধিকাংশই সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। 

তিনি বলেন, 'বর্তমানে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে নারী চেয়ারম্যান আছেন মাত্র ৪৫ জন, যদিও তা পূর্বের তুলনায় বেশি। ৪৯৫ টি উপজেলা পরিষদে মোট নারী চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৭ জন। ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে নারী মেয়র রয়েছেন ৫ জন। ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে নারী মেয়র মাত্র ১ জন। আবার এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাধারণ আসনের পুরুষ প্রতিনিধিদের তুলনায় সংরক্ষিত আসনের নারীরা তিনগু ণ ভোটে/আয়তনে নির্বাচিত হলেও উন্নয়ন কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা কিছুটা উপেক্ষিত।'

ইকবাল হাসান বলেন, 'এই সম্মেলনের মাধ্যমে আশা করা যায় নারীবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়ন, নারী জনপ্রতিনিধিদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ এবং তাদের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের বিপরীতে করণীয় নির্ধারণের পথ কিছুটা হলেও সুগম হবে।'

এ সম্মেলনে ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন থেকে জানানো হয়, ২০২১-২২ অনুসারে নারী-পুরুষ সমতা উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১২৯তম, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৩১ ও ১৬১। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে (২০২১) দেখা গেছে, নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৬৫তম অবস্থানে রয়েছে। গত বছরও বাংলাদেশের এ অবস্থান ছিল ৫০তম। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের স্কোর ৭, গত বছরও তা একই ছিল। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সমতায় শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশের পরে আছে নেপাল। নারী-পুরুষের সমতায় দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১০৬। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৪০ ও ১৫৩।

এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী সরাসরি নির্বাচিত নারীর সংখ্যা ২৩ জন। এর মধ্যে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০ জনই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে, দুজন জাতীয় পার্টি এবং একজন জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদল-জাসদ থেকে নির্বাচিত হন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। বর্তমান সংসদে নারীর সংখ্যা ৩৫০ জনের মধ্যে ৭৩ জন অর্থাৎ ২০.৮৫ শতাংশ।

Comments