১৩ শতাংশ মানুষের ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া বনাম উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি বলে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে। আবার বাংলাদেশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা গত বছরের জুনে ৭ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের মে’তে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি বলে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে। আবার বাংলাদেশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা গত বছরের জুনে ৭ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের মে'তে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। দেশের মানুষ না খেয়ে নেই। কিন্তু, বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষই খাদ্য সংকটে আছে। ২ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। এটিই কি দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকার নমুনা?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদের সঙ্গে।

তাদের মতে, বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সেটার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সেই সুফল ভোগ করছে। অর্থাৎ সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশে হয়নি।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে— এগুলো হলো সামষ্টিক কতগুলো সূচকে আমাদের অবস্থান সন্তোষজনক। যেমন: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ ও রপ্তানি বেড়ে যাওয়া, এগুলো সামষ্টিক অর্থনীতি। কিন্তু, সেই প্রবৃদ্ধিটা কোন কোন খাতে এসেছে, সেটার ব্যবচ্ছেদ (ডি কন্সট্রাক্ট) করলে দেখা যায়, রপ্তানি বা পরিষেবা খাতে প্রবৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু, সেগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপরে নেই। অর্থাৎ ভালো করার সুফল সামষ্টিকভাবে সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। রপ্তানি আয় বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, সেবা খাতে আয় বাড়ছে, বড় বড় কল-কারখানায় আয় বাড়ছে, এতে কিছু মানুষের সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু, সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়টা আমাদের হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও কর্মসংস্থানে উন্নতি হয়নি। অর্থাৎ এ খাতগুলো কোনো সুফল পায়নি।'

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা (ভালনারেবিলিটি) এড়াতে পারেনি উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'যেকোনো শক আসলেই আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ি। কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব আমরা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু, এখন আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অর্থাৎ ভঙ্গুরতা কিন্তু আমরা এড়াতে পারিনি। করোনার সময় মানুষের কর্মসংস্থান ছিল না, আয়ের উৎস ছিল না। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের সঞ্চয় ভেঙে চলেছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চলছে। খাদ্য থেকে শুরু করে সেবা, প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেড়েছে।'

এখনই দেশের উন্নয়ন কৌশল পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, 'শুধু প্রবৃদ্ধিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভাবলে চলবে না। এতে কোনো লাভ হবে না। ভালনারেবিলিটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য এখন ছোট-মাঝারি শিল্পকে উজ্জীবিত করতে হবে। আমরা শুধু বড় বড় শিল্প ও মেগা প্রকল্পের দিকে নজর দিচ্ছি। সেগুলো থেকে সুফল আসতে অনেক সময় লাগবে। অত্যাবশ্যকীয় না হলে এখন সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া বন্ধ করা উচিত। মোদ্দা কথা সার্বিকভাবে আমাদের উন্নয়নের কৌশল বদলাতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের দিকে নজর দিতে হবে।'

কৃষিখাতের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, 'কৃষি খাতে আমরা খুব বেশি নজর দিচ্ছি না। এ খাতে গতানুগতিক যে প্রণোদনা ছিল, সেটাই রাখা হয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়াতে বা সারের দাম কমাতে কেন এত অনীহা? আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ আমাদের অর্থনীতিবিদরা নানা রকম কথা বলছেন যে, ভর্তুকি কমাও, সরকারের ব্যয় কমাও। কিন্তু, সরকারের ব্যয় কমানোর তো বহু উপায় আছে। অর্থ পাচার হচ্ছে, বড় বড় মেগা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, ৫ বছরের প্রকল্প ১৫ বছরে টেনে নেওয়া হচ্ছে। সেগুলো বন্ধ করে ব্যয় কমাক। রাজস্ব আয় ও আয়কর বাড়াক। ভ্যাটের দিকে নজর দিক।'

মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশেষ কিছু করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। 'বলা হয়, মানবসম্পদের উন্নয়ন হচ্ছে। কোথায় হচ্ছে? আমাদের শিক্ষার মান তো এখনো নিম্ন। আমাদের উৎপাদনশীলতার ক্ষমতা কম। আরেকটি বিষয় হলো, মোটা দাগে যেমন আমাদের সুশাসন দুর্বল, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও একই অবস্থা। বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা, সততা, সদিচ্ছা আরও বাড়ানো দরকার। শুধু কথা বলা আর বৈঠক নয়, কাজও করতে হবে, জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।'

এ মুহূর্তে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু রিজার্ভ ঠিক করলেই অর্থনীতি ঠিক হয়ে যাবে, তা সঠিক নয়। সবগুলো বিষয়ই একটি অপরটির সঙ্গে জড়িত। যদি সামগ্রিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই পেতে থাকবে। সাধারণ মানুষ এর সুফল ভোগ করবে না।'

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'গত মে মাসে পিপিআরসি ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) গবেষণায় দেশের অর্থনৈতিক সংকটের যে চিত্র আমরা তুলে ধরেছিলাম, বিশ্বব্যাংকও তাদের সমীক্ষায় বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। এই ২ গবেষণায় ধারাবাহিকতা আছে। বাস্তব পরিস্থিতি আমরা কীভাবে বুঝি? একটা হলো সমীক্ষা করে। আরেকটা হলো চাক্ষুস দৃশ্যমান যা আমরা দেখি। ২০২১ সাল থেকে টিসিবির লাইনের ওপর একটি সমীক্ষা করলে আসল চিত্র আরও উঠে আসবে। সেখানে দেখা যাবে, লাইনের আকার কী পরিমাণ বেড়েছে, কারা লাইনের মধ্যে আসলো, কীভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ওই লাইনে আসলো।'

কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মন্থর (স্লাগিস) ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অতটা হয়নি। আবার পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ ছিল মূলত সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর, অর্থাৎ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ওপর। সেখানে ক্ষুদ্রদের ওপর মনোযোগ তুলনামূলক কম ছিল। ফলে বর্তমান এ সংকট তৈরি হয়েছে।'

চলমান সংকট আরও গভীরতর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ। তার মতে, 'এ সংকটের সঙ্গে যে শুধু বৈশ্বির সংকটের সংযোগ আছে, তাই প্রধান বিষয় নয়। কোভিড থেকে আমরা কীভাবে রিকভার করলাম, কতটুকু করলাম, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো কীভাকে কোনো গ্রুপকে ফেভার করেছে, এগুলো দেখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। এখন বিশ্বব্যাংক গতকাল বলল, আমি আজকেই একটা খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি দিলাম, এভাবে শুধু স্বল্পমেয়াদি চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে সমাধান আসবে না। এগুলোও লাগবে। কিন্তু, পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমাদের যে জ্বালানি সংকট, যার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, গত এক দশকেই এগুলো বাড়ছে। এখন আমাদেরকে উভয় জায়গায় সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। একটা হচ্ছে খাদ্য, জ্বালানি ও রিজার্ভের সংকট। আরেকটা হলো মিডিয়াম টার্মের যে গ্রোথ স্ট্র্যাটেজি আমরা এতদিন অনুসরণ করেছি, সেটার একটা সার্বিক রিভিউ ও কারেকশন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সমস্যা সমাধানে এই দুটোকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।'

গত কয়েক মাসে দেশে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতির অত্যন্ত অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার তথ্য মে মাস পর্যন্ত। কিন্তু, মে মাসের পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, এতে করে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় অনেক কমে গেছে। প্রকৃত আয় কমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রথম ধাক্কাটা পড়ে খাবারের ওপর। খাবারের মান ও পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। এতে করে মানুষের দুধ-ডিমসহ এমনিতে পেট ভরার জন্য খাওয়া খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দিতে হয়। যার পরিণতি ক্ষুধার্ত-অনাহারে থাকা ও অপুষ্টিতে ভোগা। আবার এরকম পরিস্থিতিতে চিকিৎসা নেওয়া বাদ দিয়ে দিতে হয়। যার ফলে অসুস্থতা আরও বাড়ে। যেটা হলো খাদ্যের অভাবে অসুস্থতা। পাশাপাশি দারিদ্র্যের কারণে অনেকের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়।'

তিনি বলেন, 'সরকারের নিয়মিত অভ্যাস হলো সমস্যা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। এখন সমস্যা যেটা হয় যে, সরকার যখন কোনো বিষয় অস্বীকার করে, তখন তো আর সেটা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কারণ তারা তো অস্বীকারই করছে। এ পরিস্থিতি যে খারাপ হয়েছে, এর পেছনে তো সরকারও দায়ী।'

দেশের বর্তমান সংকটের পেছনে জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তার মতে, 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণেই অনেক ধরনের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রকৃত আয় কমার পাশাপাশি নতুন বেকারত্বও সৃষ্টি হয়েছে। সংকট সমাধানের পরিবর্তে সরকারে যেন উল্টো তা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সরকারের বড় ধরনের অপরাধ হয়েছে। এটাই অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো জ্বালানির তেলে দাম বাড়ানো। এটা বাড়ানোটা ছিল অযৌক্তিক।'

যথাযথ রেশনিং ব্যবস্থা চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, 'কোভিডের সময়েই রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার ছিল, যেটা করা হয়নি। ট্রাকে করে ধাক্কাধাক্কি, মানুষকে এরকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে যথাযথভাবে একটা রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার ছিল। এই যে হঠাৎ করেই চিনিসহ সব দ্রব্যের মূল্য অনেক বেড়েছে, এটা তো যথাযথ নিয়মে হয়নি। একটা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে। মনিটরিং না করে সরকার ওই সব গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।'

বর্তমানে করণীয় নিয়ে অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক জ্বালানি তেলের দাম কমানো, যথাযথ রেশনিং ব্যবস্থা করা ও যারা অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতার বদলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে সরকারর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এগুলো সরকারের হাতেই আছে। এগুলো করলে চলমান পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও লাঘব পাবে, ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচবে।'

Comments

The Daily Star  | English
justice delayed due to fake cases

A curious tale of two cases

Two cases were filed over the killing of two men in the capital’s Jatrabari during the mass uprising that toppled the Awami League government.

16h ago