নতুন জামা এখন বিলাসিতা

নূরজাহান
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে নিজের দোকানে নূরজাহান বেগম। ছবি: স্টার

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে প্রায় ২৫ বছর ধরে সেলাইয়ের দোকান চালান নূরজাহান বেগম (৪৫)। দোকানের এই আয়েই চলে তার সংসার। বস্তিতে থাকা নারীদের জন্য এত বছর ধরে নতুন জামা তৈরি করে এলেও গত ৩-৪ মাস ধরে এই ছবি যেন পাল্টে গেছে। নতুন নয়, ছেঁড়া জামা সেলাই করতে আসা নারীর সংখ্যাই বেশি।

গত মঙ্গলবার দুপুরে কড়াইল বস্তিতে নূরজাহান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। পরিবার নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। নতুন জামা বানাতে যেখানে প্রতি মাসে অন্তত ১০০ নারী আসতেন সেখানে এখন আসেন ১০-১৫ জন।

তিনি আরও জানান, গত ৩-৪ মাস ধরে দোকানে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে আসা মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর আগে কখনোই তার দোকানে এমন গ্রাহক ছিলেন না।

নূরজাহান
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে প্রায় ২৫ বছর ধরে সেলাইয়ের দোকান চালাচ্ছেন নূরজাহান বেগম। ছবি: স্টার

'গত ২৫ বছরে এমনটা দেখি নাই। নতুন জামা বানাতে কেউ আসে না। কারণ, মানুষের হাতে টাকা নাই। এ এলাকায় এখন নতুন জামা বানানো বিলাসিতা। ছেঁড়া জামা ঠিক করতে আসা নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জামা ঠিক করতে তাদের থেকে ১০-২০ টাকা নিই,' বলেন নূরজাহান।

'দোকানে প্রতি মাসে ৩৫-৪০ জন ছেঁড়া জামা সেলাই করাতে আসেন,' যোগ করেন তিনি।

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে প্রায় ৯৩ একর জমিতে প্রায় ৪০ হাজার ঘর আছে। যেখানে বাস করেন শহরের নিম্ন ও প্রান্তিক আয়ের মানুষেরা।

বরিশালের চাখার গ্রাম থেকে ১৯৯০ সালে কড়াইল বস্তিতে আসেন নূরজাহান। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ের পর স্বামীসহ এখানেই থিতু হন তিনি। প্রায় ৪ বছর গার্মেন্টসে কাজ করেন নূরজাহান। মাসে বেতন পেতেন ২৫০ টাকা। পরে শুরু করেন নিজের সেলাইয়ের দোকান।

সংসার চালাতে সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত দোকানে কাজ করেন নূরজাহান। টিনশেড ঘরের নিচ তলায় দোকান আর ওপরের তলায় বাসা। একটা ঘরেই স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকেন। স্বামী হোটেল শ্রমিক। ২ ছেলে ছোটখাটো কাজ করেন।

নূরজাহান
নিজের দোকানে নূরজাহান বেগম। ছবি: স্টার

বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাবার খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি। বলেন, 'গত ৩ মাস যাবৎ শাকসবজি, ডাল আর কখনো কখনো ডিম দিয়ে চলছে।'

'আগে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন মুরগি রান্না হলেও এখন আর পারছি না। মাসে একবার মাছ রান্না করি।' জানান, দোকানের কাঁচামালের দামও বেড়েছে। তাই নতুন কাপড় তুলতেও হিমশিম খাচ্ছেন।

'প্রতি গজ ২৭ টাকার কাপড় হয়েছে ৬৬ টাকা, ৮-১০ টাকার সুতার কোণ ৩৫-৪০ টাকা, ৩০ টাকার রাবার ১৪০ টাকা, ১২ টাকার পাটিস ২৫ টাকা। ২ মাস আগে এনজিও থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দোকানে কাপড় কিনেছিলাম। ৬-৭ মাস আগেও ১৫ দিনের মধ্যে সেই কাপড় শেষ হয়ে যেত। এখন ২ মাসেও বিক্রি হচ্ছে না,' বলেন নূরজাহান।

নূরজাহান
নূরজাহান বেগমের দোকানে অবিক্রিত কাপড়। ছবি: স্টার

'কয়েক বছর আগে সেলাই মেশিনে জামা তৈরি করে প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় হতো। আর এখন ১০ হাজার টাকাও আসে না।'

নূরজাহানের দোকানেই কথা হয় ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে।

তারা ডেইলি স্টারকে জানান, যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তার সঙ্গে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

আরও জানান, সব জিনিসের দাম বাড়ে, কিন্তু তাদের আয় বাড়ে না। বাসা বাড়িতে কাজে যান, দোকানে কাজ করেন। একই জামা পরতে পরতে ছিঁড়ে যায়, ফেঁসে যায়। নতুন জামা কেনার টাকা নেই। তাই পুরনো-ছেঁড়া জামা ঠিক করতে আসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বলেন, 'গত ১০-১৫ বছরে কখনো ছেঁড়া কাপড় সেলাই করিনি। নিজের কাছেও কষ্ট লাগে। কিন্তু, কিছুই করার নেই। সংসারে খরচ কমাতে ছেঁড়া জামাই ঠিক করে আবার পরছি।'

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে দেশের দারিদ্র্যসীমার হিসাবের সঙ্গে সরকারের তথ্যের অনেক অমিল আছে। গত কয়েক মাসে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু, মানুষের আয় বাড়েনি। এ জন্য অনেক দরিদ্র পরিবার প্রয়োজনীয় খাবার খাচ্ছে না। তারা খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। সেখানে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরা বিশ্বাসযোগ্য।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচিত এ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা। তাদের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রেশনিং সিস্টেম চালু করা। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।'

Comments

The Daily Star  | English
BNP's stance on president removal in Bangladesh

BNP for polls roadmap in 2 to 3 months

Unless the interim government issues a roadmap to the next election in two to three months, the BNP may take to the streets in March or April next year, say top leaders of the party.

7h ago