মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বানের মধ্যেই জার্মানিতে আমলাদের জ্ঞানার্জন সফর

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একটি প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা। যদিও, মাঠপর্যায়ে কাজ করে ভূগর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন যেসব কর্মকর্তারা, প্রশিক্ষণটি প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ছিল তাদের।
প্রতীকী ছবি। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একটি প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা। যদিও, মাঠপর্যায়ে কাজ করে ভূগর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন যেসব কর্মকর্তারা, প্রশিক্ষণটি প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ছিল তাদের।

স্ট্রেনথেনিং হাইড্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের অ্যান্ড আরলি ওয়ার্নিং সিস্টেম (এসএইচইডব্লিউএস) শীর্ষক প্রকল্পটির প্রশিক্ষণ আগামী ২০ থেকে ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে।

পাউবোর আওতাধীন প্রকল্পটির বাস্তবায়ন চলছে এবং একটি জার্মানি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের ৪০ কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হচ্ছে।

তবে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের কর্মীরা বলছেন, ভুল কর্মকর্তাদের ওই প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '(স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের) সমস্যা সমাধান ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জানার জন্য প্রশিক্ষণটি মূলত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজন।'

তবে, যে ৮ জন প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানি যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ২ জন যুগ্ম সচিব, একজন উপ-সচিব ও পাউবোর অতিরিক্ত প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের মতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন।

ভূগর্ভস্থ পানি বিষয়ে দক্ষতা আছে, এমন এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকেও এই প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানি যেতে নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি যাবেন না জানিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ প্রশিক্ষণে নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ৩০ অক্টোবর সরকারি আদেশ দেওয়া হয়। একদিন পর ওই কর্মকর্তা আমাদের কাছে তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

তাত্ক্ষণিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যয় সম্পর্কে জানা যায়নি।

পাউবো কর্মকর্তা ও স্থানীয় ঠিকাদার অফিস জানিয়েছে, এই সফরের খরচ ৩০ লাখ টাকার কম হবে না।

বিশ্বব্যাংকের অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ এবং ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের শূন্য সুদের ঋণের মেয়াদ ৩৮ বছর, যার মধ্যে ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে এবং এর জন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ রয়েছে।

গত ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদেশি সহায়তার ক্ষেত্র ছাড়া সরকারি অর্থায়নে সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ সফর সীমিত করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্প

তথ্য সংগ্রহ ও ট্রান্সমিশন স্বয়ংক্রিয় করার জন্য নেওয়া এই প্রকল্পের আওতায় ম্যানুয়াল পর্যবেক্ষণ কূপের পরিবর্তে ডেটা লগার ও টেলিমেট্রি সিস্টেম সংশ্লিষ্ট ৯০৫টি স্বয়ংক্রিয় কূপ স্থাপন করা হয়েছে।

ওই ডিভাইসগুলো প্রতি ঘণ্টায় তথ্য সংগ্রহ করে এবং ২ বার করে তা সংশ্লিষ্ট অফিসে পাঠায়।

ভূগর্ভস্থ পানিস্তর, পানির স্তর, হাইড্রোলিক গ্র্যাডিয়েন্ট, পানি প্রবাহের বেগ ও দিক এবং পানির গুণমান মূল্যায়ন করার জন্য ভূগর্ভস্থ জলবিদ্যা অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে।

মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রকল্পের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। এজন্য এখনো আমরা পাউবো থেকে সব ধরনের সহায়তা পাচ্ছি। কিন্তু, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর তো মাঠপর্যায়ের অফিসই এর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে।'

যে কূপগুলো স্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ১৫০টি ইতোমধ্যে অকেজো হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সমস্যা সমাধান ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মূলত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।'

সফরকারীদের প্রোফাইল

সরকারি আদেশে তথ্য অনুযায়ী এ সফরে যাচ্ছেন— পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান ও উপ-সচিব খাইরুন নাহার, মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অ্যাডমিন) এসএম আজিওর রহমান, পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্বাঞ্চল) মাহবুবুর রহমান, এসএইচইডব্লিউএস প্রকল্পের পরিচালক মশিউর রহমান, ভূগর্ভস্থ জলবিদ্যা অধিদপ্তরের পরিচালক (ভূতত্ত্ব) আনোয়ার জাহিদ, প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহতাব হোসেন ও পাউবোর সহকারী প্রোগ্রামার আলমগীর হোসেন।

পাউবো সূত্র জানায়, মাহবুর, মশিউর ও মাহতাব বোর্ডের সদস্য হলেও ভূগর্ভস্থ পানির দৈনন্দিন কাজে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

মাঠপর্যায়ে কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, 'ভূতত্ত্ববিদরা প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন না... এখন সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও আমলাদের। এ প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কী করবেন? তারা কি কূপগুলো রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করবেন?'

'শেষ পর্যন্ত, মানুষ আমাদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা না পেয়ে ঋণের বোঝা বহন করবে। এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?', বলেন তিনি।

ওই জার্মানি প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এজেন্টের ২ কর্মকর্তাও প্রশিক্ষণে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির সমালোচনা করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, 'প্রশিক্ষণ শেষে তারা যা শিখবেন, নিশ্চয়ই মাঠপর্যায়ে যেয়ে তারা সেটার প্রয়োগ করবেন না।'

গত ১২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন দেয়, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কর্মকর্তাদের জন্য সব ধরনের এক্সপোজার ভিজিট, শিক্ষাসফর স্টাডি ট্যুর, ট্রাভেলস ফর অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট (এপিএ), ইনোভেশন, ওয়ার্কশপ বা সেমিনারসহ সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

জার্মান সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি অর্থায়নে আমরা বিদেশ সফরে যাচ্ছি না। আমাদের সফরের ব্যয় প্রকল্পের অর্থায়নের আওতায় পড়ে।'

'যেহেতু ইতোমধ্যে বিদেশ সফরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাই এখানে কোনো সমস্যা নেই', বলেন তিনি।

প্রকৃতপক্ষে কূপগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করবেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাদের বাদ দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর যৌক্তিকতা কী, জানতে চাইলে ওই যুগ্ম সচিব বলেন, 'পাউবোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা যাচ্ছি।'

প্রকল্পটি তত্ত্বাবধায়ন করার উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ সফরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক মশিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সফরটি প্রকল্পের একটি অংশ। বিদেশ সফরে না গেলে আমরা বঞ্চিত হবো।'

Comments