কার টাকায় ডিসি-ইউএনওদের ‘গাড়িবিলাস’?

যখন দেশ এক ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যখন যুদ্ধ ও নানা কারণে বৈশ্বিক মন্দা ও ডলারের বাজারে অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যও জটিলতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রকল্পের খরচ কমানো এবং সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতাসাধনের নির্দেশ দেন, সেখানে কেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য কোটি টাকা দামের গাড়ি কিনতে হবে?

করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি তথা নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের বিরাট অংশের অসন্তুষ্টি, ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানিতে জটিলতা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নানা অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনীতি যখন একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সর্বক্ষেত্রে খরচ কমানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন, তখনই গণমাধ্যমের খবর—জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হচ্ছে ২৬১টি স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি)। অথচ এই গাড়ি কেনার প্রক্রিয়াটি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আটকে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি গাড়ির মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা।

মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসইউভি কেনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে মোট ব্যয় ৩৮১ কোটি টাকা ধরা হলেও সম্প্রতি টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় এখন তার পরিমাণ আরও বাড়বে। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৩ মে ২০২৪)

স্মরণ করা যেতে পারে, গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও পরে বিভিন্ন মহলে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার সমালোচনার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো—যে যুক্তি ও বাস্তবতায় ওই গাড়িগুলো কেনার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছিল, সেই বাস্তবতা কি এখন নেই? দেশে কি অর্থনৈতিক সংকট নেই কিংবা সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতাসাধনে প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা, সেই নীতি থেকে সরকার কি সরে গেছে?

অস্বীকার করা যাবে না, মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে হয় জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের। সেজন্য তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকা উচিত বলেও মনে করা হয়। কিন্তু সেই সুবিধাটি প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মে নিয়োজিতদের তুলনায় কত বেশি হওয়া যৌক্তিক ও কাঙ্ক্ষিত এবং তারা বর্তমানে যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন—সেটি কি যথেষ্ট নয়, এমন প্রশ্নও আছে।

পদোন্নতি ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার কারণে এরইমধ্যে এটি প্রমাণিত যে, সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্য যেকোনো ক্যাডারের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। সবশেষ গত ২২ এপ্রিলও অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭ কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। এর আগে গত বছরের মে মাসেও প্রশাসনের ১১৪ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছিল। ২০২২ সালের ০৩ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম ছিল: 'পদ নেই, কাজও আগের, তবু তাঁদের পদোন্নতি'।

খবরে বলা হয়, 'জনপ্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ আছে সব মিলিয়ে ৫০২টি। যদিও এই পদের বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা রয়েছেন ৭১৭ জন। নতুন করে পদোন্নতির প্রক্রিয়াও চলছে। যুগ্ম সচিব পদের মতো অতিরিক্ত সচিব ও উপসচিব পদেও পদসংখ্যার চেয়ে কর্মকর্তা বেশি। পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা যে বাড়তি দায়িত্ব অথবা আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তা নয়। বহু ক্ষেত্রে পদোন্নতির পরও তাঁদের দিয়ে করানো হচ্ছে আগের কাজই। অর্থাৎ বড় কর্মকর্তারা এক ধাপ নিচের পদের কাজ করেন। পদোন্নতির ফলে শুধু তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ে। ফলে ব্যয় বেড়ে যায় সরকারের।'

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রশাসনের এই কাঠামোকে অনেকে 'পেটমোটা' বলে অভিহিত করেন। অথচ অন্য যেকোনো ক্যাডার, বিশেষ করে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি নিয়ে বৈষম্য ও বঞ্চনা অনেক পুরোনো আলোচনা। এ নিয়ে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বও কারো অজানা নয়।

এরকম বাস্তবতায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে ডিসি ও ইউএনওদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনার বিষয়টি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করার স্বার্থে এসব এসইউভি প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো—তারা এখন যে গাড়িতে চড়েন তা দিয়ে কি এই কাজগুলো করা সম্ভব নয়? প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মাঠ প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা কী ধরনের গাড়িতে চড়েন? তাদের একেকটি গাড়ির দাম কত? নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার বাইরেও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাদের বিরাট অংশই নানাভাবে আরও বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যান। হতে পারেন। জবাবদিহির সংস্কৃতি দুর্বল এবং অপরাধ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াগুলো নিরপেক্ষ নয় বলে কালেভদ্রে দুয়েকটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই আর কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির কথা শোনা গেলেও অধিকাংশ ঘটনাই যে আড়ালে থাকে—তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। আর এসব কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বিসিএস প্রশাসন।

তবে সবশেষ খবর বলছে, গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ক প্রস্তাব উপস্থাপিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী গত ১২ মে অনুমোদনের জন্য যে সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছেন, তাতে গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ১৫ মে ছিল ক্রয় কমিটির বৈঠক। সে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে গাড়ি কেনার প্রস্তাব রাখা হয়নি। ওই বৈঠকে গাড়ি কেনার প্রস্তাবটি টেবিলে উপস্থাপিত হয়েছিল কি না জানতে চাইলে ওই দিন সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান নেতিবাচক উত্তর দেন। (প্রথম আলো, ২৫ মে ২০২৪)

প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রজাতন্ত্রের যে কর্মচারীরা জনগণের সেবায় নিয়োজিত, তাদের জন্য দেড় কোটি টাকা দামের গাড়ি কেনায় সমস্যা কী? আপাতদৃষ্টিতে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন দেশ এক ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যখন যুদ্ধ ও নানা কারণে বৈশ্বিক মন্দা ও ডলারের বাজারে অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যও জটিলতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী সরকারি প্রকল্পের খরচ কমানো এবং সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতাসাধনের নির্দেশ দেন, সেখানে কেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য কোটি টাকা দামের গাড়ি কিনতে হবে? এই গাড়িগুলো কার টাকায় কেনা হবে? এগুলো কি জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে প্রদত্ত ট্যাক্সের পয়সা নয়? যে জনগণ কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে সেই টাকার একটি অংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারি কোষাগারে দেয়, সেই টাকা দিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য কেন কোটি টাকা দামের গাড়ি কিনতে হবে?

ধরা যাক সরকারের হাতে অনেক টাকা আছে। তারপরও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনা নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা যারা মাঠ প্রশাসনে কাজ করেন, তাদেরকে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। তৃণমূলের মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হয়। যদি তারা এগুলো হতে না পারেন, তখন জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয় 'স্যার ও ভৃত্যের'। সাংবিধানিকভাবে তারা যে জনগণের সেবক, তাদের মুখ থেকেই তারা 'স্যার' শব্দটি শুনতে চান। শুনতে না পেলে মন খারাপ করেন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানান।

প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই যে দূরত্ব, সেটি একদিনে তৈরি হয়নি। অভিযোগ আছে, জনগণকে 'ভৃত্য' বা অধীনস্ত মনে করার চিন্তাটি তাদের প্রশিক্ষণ পর্যায়েই মনের ভেতরে গেঁথে দেওয়া হয়। যে কারণে সরকারি অফিসগুলো কখনোই (খুব ব্যতিক্রম ছাড়া) জনগণের জন্য একটি ওপেন বা খোলামেলা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ওঠেনি বলেই তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও নেতিবাচক। আর যাদের সম্পর্কে সাধারণের গড়পড়তা ধারণাই নেতিবাচক, তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রসঙ্গ এলে সেটি নিয়ে সমাজের অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। কেননা সরকারি অফিসগুলোয় গিয়ে তাদের যেভাবে বিনা হয়রানি, বিনা ঘুষ ও সম্মানের সঙ্গে সেবা পাওয়ার কথা ছিল, সেটি যারা দিতে ব্যর্থ হন, তারাই যখন ওই জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, সেটি জনগণের বিরাট অংশের মধ্যেই ক্ষোভের সঞ্চার করে।

বাস্তবতা হলো, একজন ব্যবসায়ী নিজের উপার্জিত অর্থে যদি কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়েন, সেটি নিয়ে জনমনে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান যদি তার প্রতিষ্ঠানের কোনো সিনিয়র সহকর্মীর জন্য কোটি টাকা দামের গাড়ি দেয়, সেটিও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয় জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়। তাদের বেতন-বোনাস, তাদের আবাসনসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধাই জনগণের পয়সায় নিশ্চিত করা হয়। তার ওপর সেই জনগণকে সার্ভিস দেওয়ার বিনিময়ে সরকারি লোকজন সেই জনগণের কাছ থেকেই ঘুষ নেন। অথচ ওই কাজটি করার জন্য তাকে বেতন দেওয়া হয়। ফলে যখনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রশ্ন ওঠে, তখন জনমনে সেটি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বছরের পর বছর ধরে তাদের ব্যাপারে জনমনে ধারণা এতটাই নেতিবাচক হয়ে গেছে যে, এখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোনা যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় সুবিধার প্রসঙ্গ এলেও অনেকে সেটিরও সমালোচনা করেন।

অর্থাৎ জনগণ যদি মাঠ প্রশাসন তথা সরকারি অফিসগুলোয় গিয়ে কোনো ধরনের হয়রানি ও ঘুষ ছাড়া এবং সম্মানের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে সেবা পেত এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি জনগণকে সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক মনে করে তাদের সঙ্গে সেভাবে আচরণ করতেন, তাহলে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী সুবিধা পাচ্ছেন—সেটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠত না।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments