ডাকছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

কাঞ্চনজঙ্ঘা, বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। ভারতের সিকিম ও নেপাল সীমান্তে এর রাজকীয় চূড়া অবস্থিত যা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে। শীতের শুরুর দিকে যখন আকাশ মেঘ এবং কুয়াশামুক্ত থাকে তখন ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী এবং পঞ্চগড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে খালি চোখেই এই পর্বতশৃঙ্গের অপরূপ রূপ দেখা যায়।
কাঞ্চনজঙ্ঘা
অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছবি: মোস্তফা সবুজ/ স্টার

কাঞ্চনজঙ্ঘা, বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। ভারতের সিকিম ও নেপাল সীমান্তে এর রাজকীয় চূড়া অবস্থিত যা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে। শীতের শুরুর দিকে যখন আকাশ মেঘ এবং কুয়াশামুক্ত থাকে তখন ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী এবং পঞ্চগড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে খালি চোখেই এই পর্বতশৃঙ্গের অপরূপ রূপ দেখা যায়।

প্রতিবছর শীতের শুরুতে এই স্থানটি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। প্রায় সব বয়সের মানুষ কাঞ্চনজঙ্ঘার অবর্ণনীয় রূপের সৌন্দর্য উপভোগে ভিড় জমান উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। বিস্তীর্ণ চা-বাগানের সবুজ গালিচার মধ্যে সোনার আলোয় উদ্ভাসিত হয় এর নৈসর্গিক রূপ।

ভোরে সূর্যের আলো পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায়। ছবি: মোস্তফা সবুজ/ স্টার

সাধারণত সকাল সাড়ে ৫টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। যেন চোখের পলকে সামনে ভেসে উঠে পর্বতটি। সূর্যের আলো মাটিতে পড়ার কয়েক মিনিট আগে যখন ভোরের প্রথম কিরণ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া স্পর্শ করে তখন শ্বেতশুভ্র এই পর্বতটি  হয়ে ওঠে উত্তপ্ত লাভার মতো লাল।

পাহাড়ের চূড়া ছাড়াও, ভারতের কালিম্পং শহরের যানবাহন চলাচল এবং বৈদ্যুতিক আলো, দার্জিলিংয়ের মহকুমা সদর দপ্তর এবং রাতে প্রদর্শিত ভারতের সীমান্ত বাহিনীর ওয়াচ লাইট তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলো এলাকা থেকে উপভোগ করা যায়।

ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে মেঘের মধ্যে বিরল-সূর্যাস্ত আরেকটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সন্ধ্যায় মহানন্দা নদীর তীরে বসে এই দৃশ্য দেখতে পান পর্যটকরা। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রত্নস্থল ভিতরগড়, পঞ্চগড় সদরের রক মিউজিয়াম, বোদা উপজেলার বোদেশ্বরী মন্দির, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, আটোয়ারী উপজেলার ইমামবাড়া মসজিদও কম মনোমুগ্ধকর নয়।

পঞ্চগড়ে নদীর পাড় থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছবি: মোস্তফা সবুজ/ স্টার

পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়রা, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তারা বিভিন্ন নতুন সেবা ও সুযোগ-সুবিধা চালু করলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।

পঞ্চগড়ের পর্যটন শিল্প বিকাশে যেসব স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন তাদের মতে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড এবং পর্যটন করপোরেশন এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে এবং পর্যটকদের জন্য আরও ভালো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সারা দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য তেঁতুলিয়ার দিকে ছুটছেন।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা আসেন পঞ্চগড়ে। ছবি: মো. কামরুল ইসলাম রুবাইয়াত/ স্টার

দুই ছেলেকে নিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে খুব ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছেন চিকিৎসক খাদিজা বেগম।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার অপরূপ রূপ এবং এর চারপাশের সৌন্দর্য আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে।'

তিন বন্ধুর সঙ্গে নওগাঁ থেকে আসা মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশ থেকে খালি চোখে পরিষ্কারভাবে এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা একটি অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা।'

তবে একটি আদর্শ পর্যটনস্থল হওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চগড় অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। পর্যাপ্ত আবাসন, মানসম্পন্ন খাবার হোটেল এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে পঞ্চগড়ে আরো অনেক বেশি পর্যটক আসবে বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ।

সরেজমিনে দেখা যায় পর্যাপ্ত যানবাহন এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাব রয়েছে যা পর্যটকদের পঞ্চগড়ে দীর্ঘকাল থাকার পরিকল্পনা করতে নিরুৎসাহিত করছে ।

তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রতিদিন এখানে ৫০০ এবং ছুটির দিনগুলোতে প্রায় ৫ হাজারের বেশি পর্যটক আসেন। তবে তেঁতুলিয়ায় মাত্র আড়াইশ পর্যটকদের জন্য রাত্রিকালীন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে । ফলে অনেক পর্যটক তেঁতুলিয়াতে রাত্রি যাপন করতে চাইলেও সে সুযোগ পাচ্ছেন না।

ফারজানা রহমান সম্প্রতি তার তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে রংপুর থেকে তেঁতুলিয়া আসেন। রাতে সেখানে থাকতে চাইলেও কোনো থাকার জায়গা পাননি। তাকে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।

অনেক পর্যটক নারী ও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টয়লেট এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি পণ্য রাখার কথাও বলেছেন।

শরিফুল ইসলাম নামের একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, পর্যটকদের ভীড়ের কারণে ঢাকায় ফিরতে তার কষ্ট হচ্ছে। দুই দিন অপেক্ষা করেও বাস এবং ট্রেনের টিকিট পাননি তিনি।

তেঁতুলিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন সচেতন আছে এবং তাদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার্থে কাজ করছে।

তিনি বলেন, এখানে ১৮টি গেস্ট হাউজ এবং হোটেলে ২০০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে এছাড়া 'কমিউনিটি ট্যুরিজম'-এর উদ্যোগের অংশ হিসেবে ভাড়া দিয়ে স্থানীয়দের বাসা-বাড়িতে আরও ১০০ জন দর্শনার্থী রাত্রি যাপন করতে পারেন। কমিউনিটি ট্যুরিজমের জন্য গত বছর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহায়তায় ৩০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, বলেন এই ইউএনও।

তেঁতুলিয়া বাজারের দোয়েল আবাসিক হোটেলের মালিক মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, 'পিক সিজনে পর্যটকদের চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। খুব কম রুম রয়েছে আমাদের।'

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রধান ও পঞ্চগড়ের পর্যটন উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি হাসনুর রশিদ বাবু বলেন, এই এলাকায় পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে এটি হওয়ার জন্য, কর্তৃপক্ষের উচিত পর্যটন সুবিধা বাড়ানো এবং স্থানীয়দের মধ্যে পর্যটন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যোগ করেন করেন তিনি।

ফিরোজ আল সাবাহ: যার ছবির কারণে পঞ্চগড়ে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বা অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কোনো উদ্যোগের কারণে নয়। মূলত স্থানীয় এক সৌখিন আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ (৩১) নামের এক যুবকের তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি দেশজুড়ে পর্যটকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। যা কারণে রাজকীয় এই পর্বতশৃঙ্গকে একবার স্বচক্ষে দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক পঞ্চগড়ে আসেন।

প্রকৃতিপ্রেমী এই আলোকচিত্রী কিশোর বয়স থেকেই প্রকৃতি এবং পাখ-পাখালির ছবি তোলেন এবং ২০১২ সাল থেকে ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে পর্যটকদের পঞ্চগড়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। ছবি: মোস্তফা সবুজ/ স্টার

এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নানা বাধার সম্মুখীন হন। অনেক সময় মানুষ তার ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করা শুরু করেন। কেউ কেউ গুজব তোলেন যে তার তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিগুলো তেঁতুলিয়া থেকে নয় ভারতের দার্জিলিং থেকে তোলা কিন্তু কোনো কিছুই ফিরোজকে দমাতে পারেনি। একটা সময় তার তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিগুলো দেশীয় পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।

স্থানীয়রা মনে করেন ফিরোজের ছবির জন্য দিন দিন পঞ্চগড়ে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। এই এলাকার পর্যটন শিল্পের বিকাশে ফিরোজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন।

ডেইলি স্টারের সাথে কথা বলার সময়, ফিরোজ বলেন, 'আমি ২০১২ সাল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলি এবং ফেসবুকে পোস্ট করতে শুরু করি কিন্তু প্রথমে স্থানীয়রা আমাকে পাগল বলা শুরু করেন। তবে এখন তেঁতুলিয়ার অবস্থা আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন দিন দিন অনেক মানুষ এখানে আসেন শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য।'

'২০১৮ সালে আমার তোলা একটি ছবি ভাইরাল হলে পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বেড়ে যায় এবং পর্যকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে,' বলেন ফিরোজ।

তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের স্টেনো টাইপিস্ট, সিএ হিসেবে গত ১০ বছর ধরে কাজ করছেন কবির হোসেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ফিরোজের ফটোগ্রাফি প্রতিবছর পর্যটক বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তার তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার অনেক ছবি মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ইন্ডিয়ান টাইমস তার ছবি ছাপিয়েছে।'

তেঁতুলিয়ায় সম্প্রতি ভ্রমণের সময়, এক নারী ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার লাবনী ইসলাম, (৩২) বলেন, 'ফিরোজের ছবি দেখার পর আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া দেখতে তেঁতুলিয়া এসেছি। তার ছবিগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। আশা করি এবার আমিও কিছু ভালো ছবি তুলতে পারবো।'

তেঁতুলিয়া উপজেলার অনেক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ মালিকরাও তাদের ব্যবসা জমজমাট হওয়ার জন্য ফিরোজের কাছে কৃতজ্ঞ বলে জানিয়েছেন ।

তেঁতুলিয়ার জনপ্রিয় রেস্তোরা 'বাংলা হোটেল' এর মালিক আজিজুল হক বলেন, 'আজ থেকে মাত্র ১০-১২ বছর আগেও খুব বেশি মানুষ এখানে আসতেন না। ফিরোজ ভাই প্রথমে কিছু বিরল পাখির (যা শুধুমাত্র পঞ্চগড়ে দেখা যায়) ছবি তুলে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাতেন। আমরা মনে করতাম তার এই প্রচেষ্টা বৃথা যাবে কিন্তু যখন তার কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি ভাইরাল হয়, তখন পর্যটকের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে আমি পিক টাইমে আমার সমস্ত গ্রাহকদের একসাথে খাওয়াতেও পারি না।'

ফিরোজ অবশ্য পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা ও গাইডের অভাবের কথা উল্লেখ করেন।

'প্রশাসন বা বেসরকারি উদ্যোগে দর্শনার্থীদের জন্য প্রশিক্ষিত ট্যুরিস্ট গাইড থাকা দরকার। এখান থেকে আরও অনেক চূড়া দেখা যায় যেগুলো হয়তো পর্যটকরা জানেন না। গাইডরা তাদের সাহায্য করতে পারেন এবং পঞ্চগড়ের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জানাতে পারেন। অনেক মানুষ এখানে আসেন এখানে মহারাজা দীঘি [পুকুর] দেখতে, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস, বিশেষ করে ১৪০০ বছরের পুরনো ভিতরগড় দুর্গের সম্পর্কে খুব কম লোকই জানেন, বলেন ফিরোজ।

Comments