আরসাদ আলীদের দুঃখ বারোমাস

আরসাদ আলী (৮০) স্ত্রী হালিমা খাতুনসহ (৭০) বসবাস করেন রেলওয়ে জমিতে। এই দম্পতির নিজস্ব কোনো আয় নেই। বয়স্ক ভাতা হিসেবে তারা প্রতিমাসে ৫০০ করে ১ হাজার টাকা পান। এই টাকাই চলার একমাত্র সম্বল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ১ হাজার টাকা দিয়ে ১ সপ্তাহ চলাও কঠিন হয়ে যায়।
বাড়ির উঠানে আরসাদ আলী স্ত্রী হালিমা খাতুন। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

আরসাদ আলী (৮০) স্ত্রী হালিমা খাতুনসহ (৭০) বসবাস করেন রেলওয়ে জমিতে। এই দম্পতির নিজস্ব কোনো আয় নেই। বয়স্ক ভাতা হিসেবে তারা প্রতিমাসে ৫০০ করে ১ হাজার টাকা পান। এই টাকাই চলার একমাত্র সম্বল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ১ হাজার টাকা দিয়ে ১ সপ্তাহ চলাও কঠিন হয়ে যায়।

তাদের মেয়ে নাসিমা বেগম ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। নাসিমা বেগমের কাছ থেকে ৬ মাস আগে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা পেতেন। কিন্তু এখন আর পাচ্ছেন না। লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামের বয়স্ক এই দম্পতির জীবন-জীবিকা দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।

আরসাদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে গ্রামের পরিচিতজনদের কাছে সহযোগিতা চাইলে পেতাম। কিন্তু এখন পাচ্ছি না। গ্রামের মানুষও বলছেন হাতে টাকা নেই। প্রতিমাসে বয়স্ক ভাতা পাই ৫০০ টাকা। স্ত্রীও বয়স্ক ভাতা পায়। দুজনের প্রতিমাসে ১ হাজার টাকায় চলতে হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়েছে তাতে ১ হাজার টাকা দিয়ে এক সপ্তাহ সংসার চালা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।'

আরসাদ আলীর স্ত্রী হালিমা খাতুন ডেইলি স্টারকে জানান, কয়েকমাসে তাদের মেয়ে নাসিমা প্রতিমাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতো। এখন আর দিতে পারছে না। মেয়ের রোজগার নাকি অনেক কমে গেছে তাই টাকা দিতে পারছে না। আগে ১০০ টাকায় যে জিনিস কেনা যেতো এখন তা কিনতে ২০০ টাকা লাগে। খুব কষ্টে দিনকাল পার করতে হচ্ছে।

হালিমা খাতুন বলেন, 'মোর সওয়ামীটা পেটের ভোগ সহ্য করির পায় না। ভোগ নেইগলে মোর কাছোত খাবার চায়। মুই কোটে থাকি খাবার দ্যাং। বুড়াক খাবার দিবার না পায়া মুইও কাঁন্দোং। হামরা বুড়া-বুড়ি মাসে যে ১ হাজার টাকা বয়স্ক ভাতা পাং তাক দিয়া ৭ দিনও চইলবার পাং না। হামাগুলাক উপাস থাকা নাগে।'

বনগ্রাম এলাকার আকবর আলী ৬-৭ মাস আগে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ টাকা আয় করতেন। এখন ৩০০ টাকা রোজগার করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের বনগ্রাম এলাকার আকবর আলী (৬৫) ডেইলি স্টারকে জানান, তার একটি ঘোড়ার গাড়ি আছে। ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল পরিবহনের জন্য তেমন আর ডাক আসে না। ৬-৭ মাস আগে তিনি প্রতিদিন ৬০০-৭০০ টাকা আয় করতেন। এখন ৩০০ টাকা রোজগার করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোজগারের অর্ধেক ব্যয় করতে হয় ঘোড়ার খাদ্য কেনার জন্য। বিভিন্ন স্থান থেকে ঘোড়ার জন্য ঘাস সংগ্রহ করতে হয়।

তিনি বলেন, 'হামরাগুলা গরীব মানুষ। হামারগুলার কষ্টের শ্যাষ নাই। আগের চ্যায়া হামারগুলার আয় রোজগার অনেক কমি গ্যাইছে। কিন্তু জিনিসপাতির দাম অনেক বাইড়ছে। বাজারোত গ্যাইলে অল্প জিনিস কিনতে টাকা শ্যাষ হয়া যায়। গ্রামোত আইসলে বুঝা যাবে মানুষ কত কষ্টোত আছে।'

একই গ্রামের তনসের আলী (৬৪) ডেইলি স্টারকে জানান, আগের চেয়ে রোজগার বাড়েনি, কিন্তু খাবার কিনতে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। এখন হাতে টাকা জমাতে পারছেন না। বরং হাতে জমানো টাকা খরচ করে শেষ করতে হচ্ছে।

 'এ্যালাতো ফির একদিন কাজ পাই তো আর একদিন কাজ পাওয়া যাবার নাইগছে না। সামনের দিনগুলোত যে কী হয় আল্লাহই জানেন,' তিনি বলেন।

তনসের আলীর স্ত্রী নাসিমা খাতুন (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, "এ্যালা খাবার পিছোনত সোকগুলা টাকা খরচ করা নাইগবার নাগছে। তাং হামাকগুলাক একবেলা আধা খাবার খাওয়া নাইগছে। ঘর-দরজা ঠিক করির পাবার নাইগছোং না। কামাইও তেমন নাই। ম্যালা দিন থাকি হামারগুলার মুখোত মাছ-মাংস উঠে না। মনে হয় সামনের দিনগুলোত হামারগুলার আরও কষ্টো বাড়ি যাইবে।'

লালমনিরহাট শহরের ডালপট্টি এলাকায় মুদির দোকানদার আমিনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, '৩-৪ মাস আগে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতেন। এখন দেড় হাজার টাকার মতো পণ্য বিক্রি করতে পারেন। মানুষের চাহিদা আছে কিন্তু কেনার সামর্থ্য না থাকায় তারা দোকানে আসছেন না। সবগুলো দোকনদারের অবস্থা একই।'

একই এলাকার খাবার হোটেল মালিক ভবেন চন্দ্র রায় ডেইলি স্টারকে জানান, কয়েকমাস আগে তার দোকানে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ কাস্টমার আসতেন। প্রত্যেক কাস্টমার ১৫-১০০ টাকা খরচ করতেন। এখন তার দোকানে গড়ে ২০০ কাস্টমারও আসছেন না। লোকজনের হাতে টাকা না থাকায় তারা হোটলেও আসছেন না। দিনদিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

Comments