শতবর্ষী নৌকার হাট

পটুয়াখালীর কলাপাড়া শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় শতবর্ষের একমাত্র নৌকার হাটটিতে বছরে প্রায় ১ হাজার নৌকা বিক্রি হয়।
শতবর্ষী নৌকার হাট
পটুয়াখালীর কলাপাড়া শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় শতবর্ষের একমাত্র নৌকার হাট। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

পটুয়াখালীর কলাপাড়া শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় শতবর্ষের একমাত্র নৌকার হাটটিতে বছরে প্রায় ১ হাজার নৌকা বিক্রি হয়।

এই হাটকে কেন্দ্র করেই টিকে আছে নৌকা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ২০ পরিবার।

জেলার কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, গলাচিপা উপজেলার এবং বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলার জেলেরা মাছ শিকারের জন্য ২০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৫ ফুট প্রস্থের নৌকা কিনে থাকেন।

সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে নৌকা বেচাকেনা হলেও সাপ্তাহিক সোমবারের বাজারে ক্রেতাদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। তুলনামূলকভাবে বর্ষাকালে নৌকা বিক্রি বেশি হয়।

চাম্বল, মেহগনি, রেন্ট্রি ইত্যাদি দেশীয় গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়ে থাকে। কাঠের মানের ওপর নৌকার দাম কম বেশি হয়।

পার্শ্ববর্তী বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার চুনাখালী গ্রামে তৈরি হয় এসব নৌকা। সেখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের এই বাজারে ভ্যানে করে এসব নৌকা নিয়ে আসেন বিক্রেতারা।

নৌকা বিক্রি করতে আসা রাজীব হাওলাদার (৪০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি আমাদের বাপ-দাদার পেশা। এখন সপ্তাহে ৩-৪ টি নৌকা বিক্রি করতে পারি। প্রতিটি নৌকার দাম পরে ৬ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা।'

'১০-১৫ বছর আগেও নৌকার অনেক চাহিদা ছিল। তখন সপ্তাহে ১০/১২ টি করে নৌকা বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু নানা কারণে এখন নৌকার ব্যবহার ও চাহিদা কমেছে কিন্তু আমরা এখনও এ পেশায় আছি,' বলেন তিনি।

স্থানীয় বাজার থেকে চাম্বল, মেহগনি, রেন্ট্রি কাঠ কিনে মিস্ত্রিদের দিয়ে এ নৌকা তৈরি করেন রাজীব হাওলাদার। কেউ আরও ভালো মানের নৌকা নিতে চাইলে বাড়তি দাম দিতে হয়। এই নৌকা বিক্রি করেই চলছে তার ৫ সদস্যের পরিবার।

আরেক নৌকা বিক্রেতা জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'নৌকা বিক্রি করাই আমার পেশা। সপ্তাহে দু-একটি নৌকা বিক্রি করলেই সংসার চলে যায়। কাঠমিস্ত্রি দিয়ে নৌকা তৈরি করি। প্রতি তিন দিনে দুটি নৌকা তৈরি করা যায়। ২ জন মিস্ত্রি আছে।'

নৌকা তৈরির মিস্ত্রি রশিদ হাওলাদার (৫৫) বলেন, 'প্রতিটি নৌকার জন্য মজুরি পাই ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে। এই দিয়েই সংসার চলে যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'আগে বিভিন্ন আকারের নৌকার ব্যাপক চাহিদা ছিল। কৃষকও তাদের কৃষি কাজে, পণ্য পরিবহন, খেয়াঘাটগুলোতে পারাপারসহ নানা কাজে নৌকা ব্যবহার করতেন।'

এক সময়ে নৌকাই ছিল এ অঞ্চলের প্রধান বাহন। বর্তমানে খেয়া পারাপারের স্থলে নির্মিত হয়েছে ব্রিজ, কালভার্ট ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌকার জায়গা দখল করে নিয়েছে বাস, মাইক্রোবাস, মোটর সাইকেল, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। এতে চাহিদা কমার পাশাপাশি নৌকার গুরুত্বও কমেছে।

তবু পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, গলাচিপা এবং বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী এলাকা থেকে এখনও জেলেরা নৌকা কিনতে আসেন। এসব নৌকায় ১ জন বা ২ জন জেলে স্থানীয় খালগুলোতে মাছ ধরতে পারেন।

কলাপাড়ার ফুলবুনিয়া গ্রামের জেলে সাদের আলী (৪৫) এসেছিলেন নৌকা কিনতে। তিনি বলেন, 'আমি ৩০ বছর ধরে আন্ধামানিকসহ স্থানীয় নদীতে এই ছোট নৌকা দিয়ে মাছ শিকার করি। একটা নৌকা কিনলে তা দিয়ে দেড় থেকে দুই বছর মাছ ধরা যায়। আমাদের এলাকার নদীর পানি বেশি লবণাক্ত হওয়ায় নৌকাগুলো এর বেশি দিন টিকে না।'

এই নৌকার হাটের ইজারাদার নিতাই সরকার (৭২) বলেন, 'আমি ৩৩ বছর ধরে এ নৌকার হাটের ইজারাদার হিসেবে আছি। কলাপাড়া পৌরসভা থেকে প্রতি বছর ইজারা নিয়ে এ হাটটি পরিচালনা করি। ২০-২৫ বছর আগেও নৌকার অনেক চাহিদা ছিল। প্রতি সপ্তাহে ৫০-৬০টি নৌকা বিক্রি হতো। কিন্তু এখন বিভিন্ন কারণে নৌকার চাহিদা কমে গেছে। তবে এখনও সারা বছরই এখানে নৌকা বেচা-কেনা হয়। সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫টি ও বছরে ৫০০ এর বেশি নৌকা বিক্রি হয় এই হাটে।'

বিক্রির ১০ শতাংশ টাকা ইজারা বাবদ নেন নিতাই সরকার। চলতি বছর প্রায় দেড় লাখ টাকায় পৌরসভা থেকে এ নৌকা হাটের ইজারা নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার একমাত্র নৌকার হাট এটি। সমুদ্রগামী বড় বড় ট্রলারগুলো স্থানীয় জেলেরা নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করেন। তাই ট্রলার বিক্রির কোনো হাট নেই।

কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল হাওলাদার বলেন, 'কলাপাড়ার নৌকার হাটটি বেশ পুরনো। পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রতি বছর এ হাট ইজারা দেওয়া হয়। আগে এ হাটটি জমজমাট থাকলেও এখন নৌকার চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে হাটে নৌকার বেচা-কেনাও কম।'

 

Comments