আটঘরের শতবর্ষী ডিঙিনৌকার হাট

আটঘর কুড়িয়ানা খালে ক্রেতার অপেক্ষায় কারিগর। ছবি: লেখক

খালের পাড়ে বেঁধে রাখা হয়েছে সারি সারি ডিঙিনৌকা। আবার খাল বেয়ে নৌকা নিয়ে হাটে আসছেন বিক্রেতারা। বড় নৌকা কিংবা ট্রলারে করেও হাটে নিয়ে আসা হচ্ছে আবহমান বাংলার অতি পরিচিত এ জলযান। ঢেউয়ের তালে তালে চলছে কেনাবেচা।

এই চিত্র সন্ধ্যা নদীর শাখা আটঘর কুড়িয়ানা খাল এলাকার। পেয়ারা ও কৃষিপণ্যের ভাসমান হাটের জন্য আটঘর খালের পরিচিতি রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে আটঘর খালের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাসমান হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। এ খালে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বসে ডিঙিনৌকার হাট। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে নৌকা বেচাকেনা।

আটঘর বাজারের অবস্থান পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে। এটি দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় নৌকার হাট হিসেবেও পরিচিত।

ছবি: লেখক

দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলায় যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের বাহন হিসেবে নৌকা এখনো জনপ্রিয়। স্থানীয়দের ভাষ্য, এ অঞ্চলের মানুষের নৌকার চাহিদা মেটাতে শতবর্ষ আগে নেছারাবাদের আটঘরে এই হাটের গোড়াপত্তন হয়।

গত শুক্রবার সকালে হাট ঘুরে দেখা যায়, কেউ সড়কে দাঁড়িয়ে নৌকার দরদাম করছেন। জেনে নিচ্ছেন হাটের হালচাল।

সদর উপজেলার বাসিন্দা আবদুল জলিল হাটে এসেছিলেন নৌকা কিনতে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমার পেয়ারা ও আমড়ার বাগান আছে। এখন পেয়ারার মৌসুম শেষ হলেও আমড়ার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। আমড়া ও পেয়ারা সংগ্রহের  জন্য নৌকা দরকার। তাই নৌকা কিনতে এসেছি।'  

ছবি: লেখক

পিরোজপূরের স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠির ভীমরুলি ও বরিশালের বানারীপাড়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের এই এলাকাগুলোতে ব্যাপক আকারে পেয়ারা ও আমড়ার চাষাবাদ। মূলত এই আমড়া ও পেয়ারার চাষ হয় খাল তীরবর্তী বাগানে। যা সংগ্রহ করতে প্রয়োজন হয় নৌকার। একই সঙ্গে জলপ্রধান এলাকা বলে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার জন্যও নৌকার দরকার হয়। আবার এসব এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবারই যাতায়াতের জন্য নিজস্ব নৌকা ব্যবহার করেন। আটঘর নৌকার হাটের মূল ক্রেতা তারাই।

এসব মানুষের পাশাপাশি আটঘর হাটে নৌকা কিনতে ৩ জেলার নৌকা ব্যবসায়ীরাও ভিড় করেন।

হাটে কথা হয় স্থানীয় মৎসজীবী হরিপদ রায়ের সঙ্গে। জানালেন, মাছ ধরার পাশাপাশি প্রতিদিনের যাতায়াতের জন্যও নৌকা দরকার হয় তার। একটি নৌকা দিয়ে দিব্যি ২ বছর চলে যায়।

পিরোজপুরের কাউখালি উপজেলা থেকে আসা নৌকার পাইকার গফুর মিয়া বলেন, 'প্রতি শুক্রবার আমি আটঘর বাজারে ট্রলার নিয়ে নৌকা কিনতে আসি। এখানকার নৌকা অন্য জায়গার থেকে গুণে-মানে বেশ ভালো। দামেও সস্তা। কারিগররা সরাসরি বিক্রি করেন বলে দাম কম পড়ে।'

ছবি: লেখক

আটঘরের পার্শ্ববর্তী চামি, ডুবি, একতাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েকশো পরিবার নৌকা তৈরির কাজ করেন।

এমন একজন কারিগর শতবর্ষী গঙ্গানাথ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই পেশা আজও ধরে রেখেছেন তিনি। আটঘর হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা একতা গ্রামের বাসিন্দা গঙ্গানাথ বলেন, 'একসময় আমার বাপ-ঠাকুরদা নৌকা বানিয়ে বিক্রি করত। আমিও গত ৬০ বছর ধরে নৌকা তৈরি করছি। আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ লোক নৌকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত।'

আটঘর নৌকার হাটে আকারভেদে প্রতি নৌকা বিক্রি হয় ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। দেড়শ থেকে চারশ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় বৈঠা।

চামি গ্রামের নৌকার কারিগর জহিরুল ইসলাম ৪ দশক ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি জানালেন, এখন প্রায় সারাবছর নৌকার হাট বসে। তবে বর্ষা মৌসুমে বিক্রি ভালো হয়। প্রতি হাটে ৫০ থেকে ৬০টি নৌকা বিক্রি স্বাভাবিক ব্যাপার। পেয়ারার মৌসুমে বিক্রি হয় শতাধিক।

ছবি: লেখক

বর্ষা মৌসুমে নৌকার হাট দেখতে ছুটে আসেন পর্যটকরাও। মূলত আটঘর কুড়িয়ানা ও ভীমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজার এবং বাগান দেখতে আসা পর্যটকেরাই ঘুরে যান নৌকার হাটে। 

সেদিন ঢাকা থেকে আটঘর নৌকার হাট দেখতে এসেছিলেন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী জুলকারনাইন।  বললেন, 'ফেসবুকে দেখেই নৌকার হাটে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে লঞ্চে করে রওনা দিয়েছি। এখানে আসার পর খুব ভালো লাগছে। ফেইবুকের ছবিতে দেখে যতোটা ভেবেছি বাস্তবে নৌকার হাটটি আরো বেশি সুন্দর।'

বেলা গড়াতে দেখা গেল, কেউ কেউ কেনা নৌকা বেয়েই বাড়ির পথ ধরেছেন। আবার পাইকাররা ট্রলারে করে হাট থেকে কেনা নৌকা দিয়ে যাচ্ছেন দূরবর্তী কোনো জায়গায়।

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

10h ago