তিস্তাপাড়ের জীবন

‘তিস্তা হামার কপাল থাকি সুখ কাড়ি নিছে’

তিস্তার চর, তিস্তা নদী, কালমাটি,
ফসলের বোঝা কাঁধে নিয়ে ঘরে ফিরছেন নওশের আলী। ছবি: এস দিলীপ রায়

তিস্তার চরের কালমাটি গ্রামের নওশের আলী। সত্তর বছরের নওশের আলী একসময় কৃষক ছিলেন। কিন্তু, তিস্তার ভাঙনে সব হারিয়ে তিনি এখন শ্রমিক। তিস্তার বুকে হারিয়ে গেছে তার ১৫ বিঘা জমি।

নওশের আলী প্রতিদিন ৩০০ টাকায় অন্যের জমিতে কাজ করেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে।

নওশের আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েকবছর আগোত হামারগুলার কপালোত সুখ আছিল। তিস্তা হামার কপাল থাকি সোক সুখ কাড়ি নিছে। তিস্তার চরোত ভুঁইগুলা জাগি আছে কিন্তু এইল্যাত খালি বালু আর বালু। এইল্যাত কোন ফসল হবার নাইকছে না। মুই কোনোদিন ভাবোঙ নাই যে মোক মাইনসের ভুঁইওত কামলা দ্যাওয়া নাইকবে। কপালের দোষ। আল্লাহই হামার কপালোত এইল্যা লেখি থুইছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিয়ানকা ভাত খ্যায়া বাড়ি থাকি বের হয়া যাং। সারাদিন মুখোত আর কোনো অন্ন জোটে না। সন্ধ্যার আগোত বাড়ি ফিরি আইসোং। পরে আইতের খাবার খ্যায় বিছনাত নিন্দি পড়োং। হঠাৎমঠাৎ যদি কাম না পাং তাক হইলে মোক না খ্যায়া থাকা নাগে। গ্রামোত কারো কাছোত হাওলাদও ন্যাং।'

তিস্তার চরে ফসলের খেতে সকাল থেকে কাজ করে বিকেলে বাড়ি ফিরছিলেন সালেহা বেগম (৫২)। তার মাথায় ছিল খড়কুঠোর একটি বোঝা, ক্লান্তিতে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে।

সালেহা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় হামারগেুলার অনেকগুলা ভুঁই আছিলো। ম্যালা বড় একটা ভিটেবাড়ি আছিলো। হামার বাড়িত গইলঘর আছিল, আর গইলঘরোত ম্যালাগুলা গাই-গরু আছিলো। এ্যালা আর এ্যাকনা কিছুই নাই। সোকগুলা আবাদ করা ভুঁই আর ভিটেবাড়ি কোনো এ্যালা তিস্তার নদীর প্যাটোত পড়ি আছে। এ্যালা হামরা জীবন বাঁচাই দিনাও কামলা দিয়া কামাই করি।'

একসময় লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের চর কালমাটিতে বাড়ি ছিল সালেহার। তিস্তার করাল গ্রাসে আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে খোলাহাটি গ্রামে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার স্বামী আইয়ুব আলী (৫৮) অসুস্থ।

সালেহা বেগম জানান, ১৩-১৪ বছর আগেও তাদের জমি ও বসতভিটা ছিল। তার স্বামীর ৯ বিঘা জমি ছিল। তিস্তা নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়েছেন। অর্থাভাবে সন্তানদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। নদীভাঙনে বসতভিটা ও জমি হারিয়ে তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তাকে দিনমজুরি করে সংসার চালাতে হচ্ছে। সারা দিন কাজ করে পান ১৮০-২০০ টাকা মজুরি। সকালে ও রাতে ভাত খেতে পারলেও দুপুরের খাবার ভাগ্যে জোটে না তার।

তিনি বলেন, 'মুই স্বপ্নোতও ভাবোঙ নাই মোক দিনাও কামলা দিয়া কামাই করা নাইগবে। হামার সংসারোত কোন অভাব আছিলো নার। হামরাগুলা সুখোত ছিলোং। তিস্তা নদী হামারগুলার সোক সুখ কাড়ি নিছে। তিস্তা হামাকগুলাক ফকির বানাইছে। হামরাগুলা এ্যালা ভাতে পাঙ না।'

'তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও' সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর নজরুল ইসলাম হাক্কানি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিস্তাপাড়ে প্রত্যেক মানুষের জীবন এক একটি গল্প, এসব গল্প বাস্তব। তিস্তাপাড়ে গেলেই চোখে পড়বে তিস্তাপাড়ের মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্তর লড়াই। এসব মানুষের প্রত্যেকেই একসময় সচ্ছল ছিলেন। কিন্তু, বন্যা ও নদীভাঙনে আবাদি জমি, বসতভিটা ও সম্পদ হারিয়ে তারা ভূমিহীন হয়ে পড়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'তিস্তা নদীটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করে একটি চ্যানেলে প্রবাহিত করা গেলে তিস্তাপাড়ের অনেক জমি আবাদযোগ্য হতো। এতে তিস্তাপাড়ের মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত।'

Comments

The Daily Star  | English

Police, Bida launch special security measures for foreign investors

Held meeting with officials of foreign companies, introduced dedicated emergency contact line

1h ago