সৌদিতে বাস দুর্ঘটনা: নিহতদের পরিবারে শোকের মাতম

নিহতদের মধ্যে অনেকেই ধারদেনা করে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কারো কারো ঋণ এখনো পরিশোধ করা হয়নি। 
সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমে বাস দুর্ঘটনায় নিহত নোয়াখালীর হেলাল উদ্দিনের বাড়িতে ও লক্ষ্মীপুরের সবুজের বাড়িতে শোকের মাতম বইছে। ছবি: আনোয়ারুল হায়দার/স্টার

সৌদি আরবের দক্ষিণ-পশ্চিমে বাস দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারে শোকের মাতম বইছে।

সৌদি আরবে গত সোমবার বাস দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে ১৮ জনে দাঁড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ধারদেনা করে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কারো কারো ঋণ এখনো পরিশোধ করা হয়নি। 

সৌদি আরবে বাস দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন মুরাদনগরের দক্ষিন রামচন্দ্রপুরের মোস্তাপুর গ্রামের মামুন মিয়া। মাত্র ৬ মাস আগে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি।

মামুনের বাবা আবদুল আওয়াল বলেন, '৫ লাখ টাকা খরচ করে তাকে সৌদিতে আরবে পাঠিয়েছিলাম। পুরো টাকা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করা।'

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'আমার ছেলে ১২ দিনের ছুটি পেয়ে ওমরা করতে গিয়েছিল।'

৬ মাস আগে মামুন তার মামা ইয়ার হোসেনের মাধ্যমে সৌদি আরবে যান।

তার মামী তাছলিমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেদিন বাসে মামুনের সঙ্গে তার মামা ইয়ার হোসেন এবং মামুনের ভাগ্নে জাহিদুল ইসলামও ছিল। দুর্ঘটনার পর বাসে আগুন ধরে গেলে মামুন গাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়।'

এ দুর্ঘটনায় মামুনের মামা ইয়ার হোসেন ও ভাগ্নে জাহিদ গুরুতর আহত অবস্থায় মক্কার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানান তিনি।

এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার শরীয়ত উল্যা।

পরিবারের বড় ছেলে মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে শাহেদ গত বছরের এপ্রিলে সৌদি আরব যান। সেখানে তিনি একটি দোকানে কাজ করতেন।

শহীদুলের বাবা শরীয়ত উল্যা বলেন, 'ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে আমি অনেক ঋণের জাতাকলে পড়ে যাই। শাহীদুলের উপার্জন দিয়েই আমাদের সংসার কোনোমতে চলছিল।'

একই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন কুমিল্লায় দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার এলাকার গিয়াস উদ্দিন মীর (৪৮)। তার চাচাতো ভাই সাইফুল্লাহ মীর দ্য ডেইলি ষ্টারকে বলেন, 'গিয়াস দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে সৌদিতে থাকেন। ঈদের ছুটিতে আগামী মাসে বাড়ি আসার কথা ছিল তার।'

নিহত গিয়াস উদ্দিনের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তার মৃত্যুতে যেন অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।

সৌদি আরবে নিহত চাটখিল উপজেলার মো. হেলাল উদ্দিনের চাচা ও স্থানীয় রামনারায়নপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম সাব (৫৫) বলেন, 'হেলাল বিএ পাশ করে বেশ কয়েকবছর একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছিল। গত করোনা মহামারি চলাকালীন সে চাকরি হারিয়ে বেকার জীবনযাপন করে। পরে জীবিকার সন্ধানে ও পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ১ বছর আগে সে সৌদিতে যায়।'

'হেলাল পরিবারের বড় ছেলে। সে সৌদি আরবের আবা সিটিতে একটি রোঁস্তেরায় চাকরি করতো। সেদিন ওরা ৪ জন ওমরাহ করার জন্য একসঙ্গে মক্কা নগরীর উদ্দেশে যাত্রা করে। বাস দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছে,' বলেন তিনি।

হেলালের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তার মা খুকি বেগম বিলাপ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এদিকে হেলালের স্ত্রী শাহীন আক্তার জ্যোতি স্বামীর অকাল মৃত্যুর সংবাদ শুনে ৩ বছরের কন্যা শিশুকে নিয়ে আঁকড়ে ধরে আছেন। শিশুটির ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

এদিকে দুর্ঘটনায় লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বাসিন্দা সবুজ হোসাইনের মৃত্যুর খবরে বাবা-মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ যেন থামছে না। তার মৃত্যুতে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

সবুজ দক্ষিণ রায়পুর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী মো. হারুনের ছেলে। তারা চার ভাইবোন। এরমধ্যে সবুজ পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন।

সবুজের বাবা হারুন বলেন, 'আমি মাছ বিক্রি করে সংসার চালাই। প্রায় ৩ বছর আগে বড় ছেলে সবুজকে ধারদেনা করে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। সব ঋণ এখনো শোধ করতে পারিনি। তার পাঠানো টাকাতেই আমার পরিবার চলছিল।'

সেদিন ওমরাহ করতে যাওয়ার আগে সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল সবুজের।

এদিকে সৌদি আরবে বাস দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন কক্সবাজারের বড় মহেশখালী ইউনিয়নের ফকিরা ঘোনা গ্রামের মো. আসিফ (২৪) ও মগরিয়া গ্রামের মো. শেফায়েত উল্লাহ (২২)। তারা দুজন সম্পর্কে খালাতো ভাই।

শেফায়েত উল্লাহর বড়ভাই জাহেদুল ইসলাম জানান, ২ বছর আগে শেফায়েত সৌদি আরবে যান। তার আগে দুই বড় ভাই সাইফুল ইসলাম ও শাহাজাহান ইসলামও সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তারা ৩ ভাই সৌদি আরবের আবাহা কামিছ এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলে চাকরি করেন। অন্যদিকে, খালাতো ভাইদের সহযোগিতায় ২ বছর আগে সৌদি আরবে পাড়ি দেন মোহাম্মদ আসিফ।

দুই ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর খবরে মঙ্গলবার সকাল থেকেই তাদের পরিবারের আহাজারি শুরু হয়। প্রতিবেশীসহ আশপাশের লোকজন তাদের বাড়িতে ভিড় করেছেন এবং সাত্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের বাহারকাচা গ্রামের মোহাম্মদ হোসেনের (৩৫) বাবা কাদের হোসেন বলেন, 'হোসেন ৬ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে। ৭ বছর আগে সে সৌদি আরবে। তার স্ত্রী ও ৪ বছরের এক কন্যা সন্তান আছে0। ছেলের উর্পাজনেই আমাদের সংসার চলতো। এখন সন্তানকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছি।'

Comments