অন্তিম শয়ানে ডা. জাফরুল্লাহ: ‘এমন দরদি ভবে কেউ হবে না’

শ্রদ্ধার ফুল আর চোখের পানিতে তাকে বিদায় জানালেন আপামর জনতা।
জানাজা শেষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সূচনা ভবনের সামনে সমাহিত করা হয়। ছবি: পলাশ খান/স্টার

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাবেক প্যারামেডিক মো. শফিকুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একইসঙ্গে তার শিক্ষাগুরু এবং বড়ভাই। পাশাপাশি জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শফিকুর দেখেন 'তৃণমূল স্বাস্থ্যসেবার জনক' হিসেবে।

আজ শুক্রবার সকালে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ মাঠে প্রয়াত এই দরদি বীরকে শেষবারের মতো দেখতে এসে তার জন্য খোলা শোকবইয়ে শফিকুর লেখেন, 'এমন দরদি ভবে কেউ হবে না'।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনাভাইরাস মহামারি পর্যন্ত পুরো ৫ দশকে কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশে অনেকেই যাকে সম্বোধন করেন 'গরিবের ডাক্তার' হিসেবে।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাবতেন, দরিদ্র জনগণের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে জাতির ভাগ্য। এ জাতির বেঁচে থাকার সব মৌলিক উপাদানই এদেশে আছে। সুষ্ঠু বণ্টন হলে জাতির প্রতিটি লোকের মৌলিক চাহিদা মিটবে। এতে বিলাসী জীবন-যাপন সম্ভব না হলেও গৌরব নিয়ে বাঁচা যাবে।

এমন ভাবনা থেকেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। আর সাম্যের বিশ্বাসে দরদি মন দিয়ে তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন দেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের কষ্ট। চিহ্নিত করেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাজমান চ্যালেঞ্জগুলোকে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে তৈরি করেছিলেন শফিকুর রহমানের মতো প্যারামেডিকদের।

যে দরদ দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই মানুষগুলোকে তৈরি করেছিলেন, তার শেষ বিদায়ের দিনে সেই দরদ, সেই ভালোবাসা ফিরে আসলো বহুগুণ হয়ে। শ্রদ্ধার ফুল আর চোখের পানিতে তাকে বিদায় জানালেন আপামর জনতা।

নিজ হাতে গড়ে তোলা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিবিধ জনমুখী কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আজ জুমার পর এর প্রাঙ্গণেই জানাজা শেষে এখানেই অন্তিম শয়ানে শায়িত হলেন তিনি।

এর আগে সকাল ৯টার দিকে গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ থেকে গণস্বাস্থ্য পিএইচএ মাঠ প্রাঙ্গণে নেওয়া হয় ডা. জাফরুল্লাহর মরদেহ।

এরপর থেকেই সেখানে জড়ো হতে শুরু করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মী, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বেচ্ছাসেবকসহ সর্বস্তরের মানুষ। তারা ছাড়াও স্থানীয় ইউনিয়ন ও উপজেলার বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা জানাতে আসে স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র একটি পাবলিক ট্রাস্ট। কোনো ব্যক্তি এর মালিক নন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের সমন্বয়কারী। আর দশ জনের মতো তিনি নিজেকেও এখানকার একজন কর্মী হিসেবে দাবি করতেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার মতো করে নির্দিষ্ট একটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাকে সামনে নিয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাকে তিনি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য হলেও যে সাধ্যমতো অনুধাবন করার অবকাশ তৈরি করতে পেরেছেন, তা বোঝা গেল তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে।

তিনি বিশ্বাস ও চর্চায় ছিলেন সাম্যবাদী, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। সকাল সাড়ে ৯টার পর ঘোড়াপীর মাজারের মোড় থেকে বায়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কমপ্লেক্সে ঢুকতে দেখা গেল, গাছের গায়ে গায়ে ঝুলছে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা, 'বড় ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের শোকাহত করেছে। তবে তার দেওয়া দিক-নির্দেশনা আমাদের শক্তি।'

জানাজা শেষে দাফনের জন্য নেওয়া হয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ। ছবি: পলাশ খান/স্টার

আরেকটা প্ল্যাকার্ডে লেখা, 'বড় ভাই আপনি যেখানে থাকেন শান্তিতে থাকেন। আমরা আপনার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব।'

অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই সাভারে ১২০ একর জমির ওপর একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছেন দরদি বীর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এখানে প্রতিষ্ঠানের সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন, একসঙ্গে এক টেবিলে একই ধরনের খাবার খান। এখানে সবাই কর্মী। আর তিনি তাদের বড় ভাই।

এদিন ঘোড়াপীর মাজার মোড় এলাকায় কথা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শুরুর দিককার কর্মী মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে। ২০১২ সালে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চাকরি ছাড়লেও এখনো ওই এলাকাতেই থাকেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'মানুষ হিসেবে বড় ভাইয়ের অবস্থান অনেক উপরে। কেন্দ্রে একবার দুপুরের খাওয়ার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিচ্ছিলাম। হঠাৎ টের পাই উনি পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি আমাকে সেটা করতে দিলেন না।'

১৯৮২ সালের যে ওষুধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, সেই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।

অসুস্থতা নিয়ে ঢাকার ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যু হয়।

স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। কোভিড মহামারির সময় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে নমুনা পরীক্ষার কিট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, যদিও সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, ডা. জাফরুল্লাহ সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। গরিব মানুষের কাছে সুলভে উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া ডা. জাফরুল্লাহর সব কর্মকাণ্ডের মূল সুর ছিল। এটা করতে স্বাস্থ্যসেবা বলতে কী বোঝায়, সেটাও তিনি নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে।

১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসাবে পরিচিত 'র‌্যামন ম্যাগসাইসাই' পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে 'ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো' হিসেবে সম্মাননা দেয়।

খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি বলতেন, 'আমি মানুষের রাজনীতি করি।'

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পর তার মরদেহ যেন চিকিৎসার গবেষণার জন্য দান করা হয়। তার মৃত্যুর পর ছোট বোন আলেয়া চৌধুরীও সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য মরদেহ দান করার পক্ষে।

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জানাজার আগে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়াত চিকিৎসকের একমাত্র ছেলে বারিশ চৌধুরী জানান, সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই হবে তার শেষ শয্যা।

এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ সম্পর্কে বারিশ চৌধুরী বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজকে এ বিষয়ে প্রস্তাব দিলে সেখান থেকে জানানো হয়েছে, তারা কেউ এই দেহে ছুরি লাগাতে পারবে না।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজায় মানুষের ঢল। ছবি: শরীফ এম শফিক/স্টার

শেষ জানাজায় মানুষের ঢল

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শেষবিদায় জানাতে আজ সকাল ১০টার আগ থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ মাঠের দিকে সারিবদ্ধ মানুষের ঢল দেখা যায়।

তাকে শ্রদ্ধা জানাতে সাভারে উপস্থিত হন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহপরিবার ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু, হামীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক মহাসচিব নইম জাহাঙ্গীর, গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর।

এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা, ট্রাস্টি সন্ধ্যা রায়, ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহধর্মিণী, নারী নেত্রী শিরীন পি হক, মেয়ে বৃষ্টি চৌধুরী, ছেলে বারিশ হাসান চৌধুরী, ভাই ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল শহিদুল ইসলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান মঞ্জুর কাদের আহমেদ, প্রেস উপদেষ্টা মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম।

দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে শ্রদ্ধা নিবেদন। এরপর জুমার নামাজ শেষে সবাই আবার পিএইচএ মাঠে জানাজা নামাজের জন্য জড়ো হন। দুপুর আড়াইটায় জানাজা শেষে ডা. জাফরুল্লাহর মরদেহ নেওয়া হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সূচনা ভবনের সামনে। সেখানে ছোট বাগানের ছায়ায় বিকেল ৩টায় তাকে সমাহিত করা হয়, যার পাশেই একটি ছোট ঘর আছে, বেঁচে থাকা অবস্থায় সেখানেই থাকতেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Uncertainty lingers over Chhatak Cement’s return to operation

State-run Chhatak Cement Company in Sunamganj might not return to production anytime soon as its modernisation project is set to miss the deadline for the second time while uncertainty over the supply of the key raw material persists.   

8h ago