রাতের আঁধারে গাছ কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

রাতের আঁধারে গাছ কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
গতকাল শনিবার রাতে কাটা হয়েছে গাছ। ছবিটি আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে আবাহনী মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে তোলা। ছবি: সুমন আলী/স্টার

উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উত্তপ্ত ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর জন্যে 'চিফ হিট অফিসার' নিয়োগ দিয়েছে। ২ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ঢাকা নগরের গাছ কেটে 'সৌন্দর্যবর্ধন' করছে।

পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজধানীর ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের গাছ কাটা অব্যাহত রেখেছে ডিএসসিসি। 

আজ রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে থেকে আবাহনী খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ পর্যন্ত সড়কের বিভাজকে থাকা সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সেখনে একটিও অক্ষত গাছ দেখা যায়নি। মিডিয়ান তৈরির কাজ করছেন মিস্ত্রিরা। অনেক জায়গায় ইতোমধ্যে মিডিয়ান তৈরি হয়ে গেছে। মিডিয়ানের ওপর স্টিলের বিভাজন দেওয়াও শুরু হয়েছে।

সাত মসজিদ রোডে চলছে গাছকাটা। ছবিটি সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তোলা। ছবি: নাঈম উল হাসান

গত শনিবার রাতেও আবাহনী খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে গাছ কাটা হয়েছে এবং গাছ কাটা অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।

সিটি করপোরেশন বলছে, উন্নয়নের স্বার্থে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এই সড়কের ২ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা থাকা সব গাছ কেটে ফেলতে হবে। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, গাছ রেখেও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা যেত।

আবাহনী মাঠের পাশে প্রায় ২০ বছর ধরে দোকান করেন মো. কিরণ (ছদ্মনাম)। আজ তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল রাত ৯টার দিকে যখন দোকান বন্ধ করে বাসায় যাই তখনো গাছগুলো ছিল। সকালে এসে দেখি গাছ নেই। এখানে মেহগনি, নিম এবং কিছু ফুল ও ফলেরও গাছ ছিল। এই গাছগুলো নাও কাটতে পারত। গাছগুলো ছায়া দিত। অক্সিজেন দিত। এই রাস্তা দিয়ে আগে যখন রিকশাওয়ালা বা রিকশায় কোনো যাত্রী যেত তারা ছায়ার মধ্যে থাকতে পারতেন আর এখন রোদে পুড়তে হচ্ছে।'

সড়কের বিভাজনে রাখা হয়নি কোনো গাছ। ছবি: সুমন আলী/স্টার

আরেক চা দোকানদার মো. মিলন বলেন, 'যখন গাছগুলো ছিল এক ধরনের ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যাওয়া যেত এখন আর পাওয়া যায় না। রাস্তাটির সৌন্দর্য ছিল, এখন আর নেই। কয়েকদিন আগে ঝড় হয়েছিল, তারপর গাছ কাটা আরও বেড়ে গেছে। গতরাত ১১টার দিকে দোকান বন্ধ করে গেছি, তখনো গাছগুলো ছিল। আজ সকালে এসে দেখি গাছ নেই।' 

রাতের আঁধারে গাছ কাটছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ছবিটি সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে তোলা। ছবি: আমিরুল রাজিব

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচণ্ড বায়ুদূষণে অভিশপ্ত, একটি তাপীয় দ্বীপে পরিণত হওয়া ঢাকাতে গাছ কাটার আগে ১০০ বার চিন্তা করতে হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনই এই গাছগুলো লাগিয়েছে। ওয়ার্ক অর্ডারে বলা হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এই গাছগুলো কাটা হচ্ছে। কিন্তু গাছ কেটে কীভাবে সৌন্দর্যবর্ধন হয় তা আমাদের জানা নেই। নতুন করে যে ডিভাইডার করা হচ্ছে সেখানে কীভাবে সৌন্দর্যবর্ধন হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। দেখতে তো একই রকম। এই গাছগুলো রেখেই সৌন্দর্যবন্ধনের কাজ করা যেত।'

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'তারা বলছে এই গাছগুলো অনিরাপদ। সুস্থ সবল গাছ অনিরাপদ হয় কীভাবে? এই অনিরাপদের সার্টিফিকেট কোন বিশেষজ্ঞ দিয়েছে আমাদের জানা নেই। বিষয়টা হচ্ছে একবার গাছ লাগাব কিছু টাকা পকেটে ভরব, আরেকবার গাছ কাটব কিছু টাকা পকেটে ভরব। তারা বলছে এখানে বাগান বিলাস গাছ লাগানো হবে। কিন্তু বাগান বিলাস গাছ তো ছায়া দেবে না। বাগার বিলাস গাছ কি অক্সিজেন দেবে? উন্নয়ন প্রকল্পের তো যৌক্তিকতা থাকতে হবে।'

'আমরা সিটি করপোরেশনের ভুল ধরিয়ে দিলাম, কিন্তু সিটি করপোরেশন কাউকে পরোয়া করল না। আমরা গতকাল সেখানে ৪টি গাছ লাগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই গাছগুলো রাখেনি, তুলে ফেলেছে। দেশে যদি গণতন্ত্র থাকত, ভোটের অধিকার থাকত তাহলে ঢাকা সিটি করপোরেশন এই ধৃষ্টতা দেখাত না। আমাদের কথা না শুনলে আমরা এই আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দেব,' তিনি যোগ করেন।

মঙ্গলবার রাতে মানববন্ধন করেছে পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকরা। ছবি: সুচিস্মিতা তিথি/স্টার

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদদ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই কাজ মূলত জিগাতলা থেকে সাত মসজিদ রোডে ২৭ নম্বরের যে মোড় আছে সেখান পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার জুড়ে হবে।'

গাছ কাটা ছাড়াই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি করা যেত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ইন্টারসেকশনগুলো আমরা পরিবর্তন করেছি। পুরো রোডজুড়ে এখন আমরা ৪টি ইন্টারসেকশন রেখেছি। আমরা বিভিন্ন বিকল্প উপায় চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু হচ্ছে না। তাই গাছ কাটতে হচ্ছে। আমরা সেখানে উন্নত প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগিয়ে দেব। এতে দ্রুত সবুজায়ন হবে। তবে উন্নয়নের স্বার্থে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে। আমরা সেই বিষয়ে সচেতন আছি।'

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমার বক্তব্য ছিল যতটুকু রাখা যায় আমরা কিছু গাছ রাখার চেষ্টা করব। জায়গা যদি ৬ ফুট হতো তাহলে কিছু গাছ রাখতে পারতাম। কিন্তু সেই মিডিয়ানের জায়গাটি ৩ ফুটেরও কম। তাই চেষ্টা করেও গাছ রাখা যায়নি। তবে আমরা দ্রুত গাছ লাগিয়ে দেব।'

কী গাছ লাগানো হবে জানতে চাইলে সালেহ আহম্মেদ বলেন, 'আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। আমাদের মেয়র এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যতটুকু জানি বাগান বিলাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাছ থাকবে।'

এই প্রকল্পে বাজেট কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সাত মসজিদ রোডে প্রায় ২ কিলোমিটারের সৌন্দর্যবর্ধনে দেড় থেকে ২ কোটি টাকা ব্যয় হবে।'

সাত মসজিদ সড়কের বিভাজকে গাছ কাটা বন্ধে আহ্বান জানিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে মানববন্ধন করে পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকরা। এর আগে গত জানুয়ারিতে সাত মসজিদ সড়কে কিছু গাছ কাটে সিটি করপোরেশন। পরে প্রতিবাদের মুখে তা বন্ধ রাখা হয়। ওই ঘটনার পর আবার গাছ কাটতে শুরু করেছে সিটি করপোরেশন।

Comments

The Daily Star  | English

Can't afford another lost decade for education

Whenever the issue of education surfaces in Bangladesh, policymakers across the political spectrum tend to strike a familiar chord. "Education is our top priority," they harp

3h ago