হোলি আর্টিজান হামলার ৭ বছর

‘এখনো তাকে দেখলে হতবাক হবেন কীভাবে তিনি বেঁচে আছেন’

সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনের ক্ষত আজো শরীরে বয়ে চলেছেন জাহাঙ্গীর।
‘এখনো তাকে দেখলে হতবাক হবেন কীভাবে তিনি বেঁচে আছেন’

চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ। পিনপতন নীরবতা। যেন ভয়ঙ্কর ঝড়ের আগের নীরবতা। যেন আসন্ন বিপদ বা মৃত্যুর আগ-মুহূর্তের নীরবতা। সেই নীরবতার মধ্যেই ক্ষীণ স্বরে আবেদন; ফিসফিস করে কেউ বললেন, 'আমাকে নিয়ে যান… বাঁচান।'

সেই ভয়ার্ত স্মৃতির কথা দ্য ডেইলি স্টারকে শোনাচ্ছিলেন এস এম জাহাঙ্গীর হাছান। তিনি স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) ইউনিটের সাবেক টিম লিডার। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে কর্মরত। সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলার পর ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে তিনিই প্রথম পা রাখেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই নৃশংস জঙ্গি হামলায় ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, ৩ বাংলাদেশি ও ১ ভারতীয় প্রাণ হারান।

সেদিনের স্মৃতি মনে করে ডেইলি স্টারকে জাহাঙ্গীর বলেন, 'প্রাথমিকভাবে আমাদের পরিকল্পনা ছিল পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সেই অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করা। তবে, একজনের বাঁচার আকুতি শুনতে পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে উদ্ধার অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নিই।'

ডানদিকে লেকভিউ ক্লিনিক ভবন, বামদিকে হোলি আর্টিজান ক্যাফে। সোয়াটের অগ্রগামী দল হিসেবে জাহাঙ্গীরের টিমের কাজ ছিল সেখানে কী ঘটছে সে সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা।

জাহাঙ্গীর বলেন, 'আমাদের দলে আমিসহ সদস্য সংখ্যা ছিল ৮ জন। হোলি আর্টিজান ক্যাফের প্রধান প্রবেশ দরজা খানিকটা খোলা দেখা গেল। আমরা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যাই।'

ক্ষীণ স্বরে বাঁচার আকুতি জানানো সেই মানুষটিকে সোয়াট টিম উদ্ধার করে একটি গাড়ির ভেতর থেকে। পরে জানা যায়, তিনি ছিলেন ফারাজ আয়াজ হোসেনের গাড়ির চালক।

জাহাঙ্গীর বলেন, 'তাকে উদ্ধার করার সময় ক্লিনিকের দিক থেকে কোনো প্রতিরোধ আসেনি। তখন বুঝতে পারি হামলাকারীদের অবস্থান উল্টো দিকে, যেখানে হলি আর্টিজান ক্যাফে।'

এরপর জাহাঙ্গীর ও তার দল ক্যাফেতে প্রবেশ করতে থাকে। জাহাঙ্গীর বলেন, 'আমিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে হোলি আর্টিজানের ভেতরে পা রেখেছিলাম। আমি ভেতরে ঢুকলাম, সামনে অনেক বড় মাঠ। সেখানেও একই নীরবতা। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে, মাথায় এটা কাজ করছে যে ভেতরে অনেক বড় কিছু হয়েছে।'

জাহাঙ্গীর বলেন, 'ভেতরে যেতে যেতে হঠাৎ দেখতে পেলাম ক্যাফের প্রধান প্রবেশদ্বারে একটি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা। তখনই বুঝতে পারলাম যে এটা কোনো সাধারণ হামলা না, এটা প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীদের কাজ।'

এই পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীর বুঝতে পারেন যে তারা বিপৎসীমার মধ্যে ঢুকে পরেছেন, তারা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। সন্ত্রাসীরা নিশ্চিতভাবেই তাদের দেখতে পাচ্ছে ভেবে খানিকটা ভয়ও পেয়ে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। ওই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে জাহাঙ্গীর তার হাতে অস্ত্র গলায় ঝুলিয়ে দলের সবাইকে পিছু হটতে বলেন।

তিনি বলেন, 'আমার সিনিয়রদের সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলেছিলাম, তাদের বের হয়ে যেতে বলছিলাম। আমি অনেক জোরে কথাগুলো বলছিলাম যেন ক্যাফের ভেতরে যারা আছে তারাও শুনতে পায় এবং তারা ভাবে যে একজন এমন কেউ আছে যে সবাইকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে।'

সৌভাগ্যক্রমে জাহাঙ্গীর যা করতে চাইছিলেন তা তার ঊর্ধ্বতনরা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তারাও ধীরে ধীরে পিছু হটতে শুরু করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জাহাঙ্গীরের দল ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

তাদের একটি দলের সামনে পরে গ্রেনেড। জাহাঙ্গীরের ধারণা গ্রেনেডটি হয়তো রাস্তার পাশে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এবং চলাচলের সময় কোনোভাবে তা রাস্তার ওপর গড়িয়ে এসে পরেছে।

তিনি বলেন, 'আমাদের দলের এক সদস্য সাব-ইন্সপেক্টর সুজন কুণ্ডু আমাকে সংকেত দেয় যে তার সামনে এমন কিছু আছে। তখন তাকে বললাম যে দেখো কোনোভাবে এটাতে সিকিউর করতে পারো কি না।'

সুজন খুবই দক্ষতা ও সাহসী ছিল। গ্রেনেডটি সিকিউর করতে বলায় তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এক পর্যায়ে গ্রেনেডের পিনটি খুলে যায় এবং তা বিস্ফোরিত হয়।

বিস্ফোরণে জাহাঙ্গীর ও তার পুরো দল গুরুতর আহত হয়। জাহাঙ্গীরের শরীরে গ্রেনেডের অন্তত ২২-২৩টি স্প্লিন্টার ঢুকে যায়।

তিনি বলেন, 'সুজনের শরীরে ওই গ্রেনেডের প্রায় ৭০ শতাংশ স্প্লিন্টার ঢুকেছে। তিনি দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। এখনো তাকে দেখলে হতবাক হবেন এবং ভাবতে বাধ্য হবেন যে এমনভাবে আহত হওয়ার পরও কীভাবে একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।'

বিস্ফোরণের পর সবাই দৌড়ে সরে যাওয়ার পর দেখা গেল ১৭-১৮ জন সেখানে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। বিস্ফোরণস্থল থেকে অল্প দূরেই ছিলেন গোয়েন্দা শাখার সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ। তারাও আহত হন।

রবিউল করিমের কথা বলতে গিয়ে চোখ পানিতে ভরে আসে জাহাঙ্গীরের। রবিউল বয়সে বড় হলেও তার ছিলেন ব্যাচমেট।

জাহাঙ্গীর জানান, রবিউল তার সঙ্গে ভেতরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর তাকে বাইরেই থাকতে বলেন। যে জায়গায় রবিউলকে তিনি দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে গিয়েছিলেন ঠিক সেখানেই আহত অবস্থায় পড়ে ছিলেন রবিউল। বিস্ফোরণে রবিউলের ফুসফুসে আঘাত লাগে এবং সালাহউদ্দিনের গলায় আঘাত লাগে। দুঃখজনকভাবে, হাসপাতালে পৌঁছানোর আধা ঘণ্টার মধ্যেই তারা মারা যান।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিস্ফোরণে আহত হয়েছিলেন। মেডিকেল টিম ডাকা হয় এবং আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পরবর্তী কৌশল নির্ধারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর সেখানে প্যারা-কমান্ডো দল মোতায়েন করা হয়।

অবশেষে ১২ ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশনের পর কমান্ডোরা ভবনটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনের ক্ষত আজো শরীরে বয়ে চলেছেন জাহাঙ্গীর। যদিও এটাকে তিনি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সুযোগ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, 'সেই দিনগুলো আমার পেশাদার জীবনের সোনালি দিন হিসেবে চিরকাল অমলিন থাকবে।'

একজন নিবেদিতপ্রাণ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে জাতির সেবায় অটল থাকতে পেরে গর্ববোধ করেন জাহাঙ্গীর।

Comments