এডিস মশা দমনে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়
প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি মাসেই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও।
চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৯ জন রোগী মারা গেছেন।
এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম ৯ দিনে মোট ৪ জন রোগী মারা যাওয়ায় ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ৬ মাসে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে মোট ৫০০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং এই মাসে মাত্র ৯ দিনে মোট ৩৫৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা নিয়ে এ বছরে ৯ জুলাই পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ৮৫৯ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতাল চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর বাইরেও অনেক ডেঙ্গু রোগী বাড়িতে এবং ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নিচ্ছেন, ফলে সরকারি এই হিসাবের বাইরেও আরও অনেক রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন।
ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসায় সচেতনতা সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, 'জ্বর কমার পর ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা সময়কাল ডেঙ্গু রোগীদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তাদের অনেকের শরীরে লিভারে পানি জমা, রক্তচাপ কমে যাওয়া ও কিডনি কাজ না করাসহ বেশকিছু জটিলতা দেখা দেয়।'
'সুতরাং রোগীদের এই সময়ে ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী অবিলম্বে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করতে হবে', বলেন তিনি।
এই মাসে ডেঙ্গু বিপজ্জনক আকার ধারণ করলেও এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞগণ।
২০২১ সালে চসিকের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক বন্দর নগরীতে একটি জরিপ পরিচালনা করেন। গবেষকরা ২০২১ সালের জুলাই মাসে নগরীর ৯৯টি এলাকায় ৫৭টি স্পটে জরিপ পরিচালনা করেন এবং পরবর্তীতে চসিকের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রতিবেদনে তারা বলেন, ১৫টি জায়গায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। পরে চসিক কর্তৃপক্ষ ওইসব এলাকায় লার্ভা ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়।
২০২২ সালে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এই ধরনের কোনো জরিপ চালানো হয়নি এবং এ বছর চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদের তত্ত্বাবধানে গতকাল থেকে মাত্র একটি জরিপ শুরু হয়েছে।
এ বছর গ্রামাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাওয়া গেলেও সরকারি তরফ থেকে গ্রামীণ এলাকায় এডিসের লার্ভা ধ্বংসে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
যেমন, চলতি বছরে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি নামে একটি গ্রামে শতাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও এ গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো মশা নিধন অভিযান শুরু হয়নি।
সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়কে এই ব্যাপারে অবহিত করলেও মশা নিধন অভিযানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
'আমাদের কাছে মশা নিরোধ অভিযান শুরু করার জন্য লজিস্টিক সরঞ্জাম নেই', বলেছেন ইউপি চেয়ারম্যান।
গ্রামের বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন বলে তিনি জানান।
যোগাযোগ করা হলে, বিআইটিআইডির ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুন মাস থেকে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগ রোগীই দেরিতে হাসপাতালে আসছেন, যে কারণে চিকিৎসায় বেগ পেতে হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'ডেঙ্গু রোগীদের অনেকেরই রক্তচাপ কম এবং রক্তে প্লেটলেটের মাত্রাও কম পাওয়া যাচ্ছে।'
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন মাস থেকে ডেঙ্গুর অতি প্রকোপ শুরু হয়। জুন মাসে মোট ২৮২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৬ জন মারা গেছে। যেখানে এই বছরে গত ৫ মাসে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যজেখানে ২১৮ জন।
এর প্রেক্ষাপটে, ২২ জুন চসিক কর্তৃপক্ষ ১০০ দিনের মশানিরোধী কর্মসূচি শুরু করে। কর্মসূচির উদ্বোধনকালে, চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নগরবাসীকে তাদের আশপাশ এবং ছাদের ওপরের বাগান নিয়মিত পরিষ্কার করার আহ্বান জানান। তা না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
তবে আশপাশ পরিষ্কার না করার জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে না। চসিক মেয়র তখন ড্রোনের মাধ্যমে ছাদের ওপরের বাগান মনিটরিং করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেও এই কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়ছে মাত্র গতকাল।
সুশীল সমাজের সদস্য ও অধিকার কর্মীদের মতে, এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধে চসিক কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।
যোগাযোগ করা হলে, চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, 'মশার লার্ভা ধ্বংসে চসিক এবং স্বাস্থ্য বিভাগ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অপর্যাপ্ত এবং এর বড় প্রমাণ চট্টগ্রামের বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি।'
'ডেঙ্গু হঠাৎ করে আসেনি। আমরা সুশীল সমাজের সদস্যরা এবং মিডিয়ার লোকজন ডেঙ্গুর কারণে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত বলে আসছি এবং লিখছি, এবং এই ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।'
চসিক যেভাবে মশানিরোধী কর্মসূচি পরিচালনা করছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পুরো প্রোগ্রামটি একজন কীটত্ত্ববিদের নেতৃত্বে হওয়া উচিত।'
যোগাযোগ করা হলে, চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এন্তেজার ফেরদৌস বলেন, 'চসিক কর্মীদের সন্ধ্যা ও ভোরের সময় উড়ন্ত মশা মারার জন্য কীটনাশক স্প্রে করা উচিত। তিনি বলেন, 'ভোর ও সন্ধ্যার আগে মশার কীটনাশক স্প্রে করার সেরা সময়, কারণ গবেষণায় দেখা গেছে ওই সময় মশার ঘনত্ব থাকে সর্বোচ্চ।'
'আমাদের গবেষণায়, আমরা দেখতে পেয়েছি, মশার ঘনত্ব খুব ভোরে (সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পরে) এবং সন্ধ্যায় (সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা আগে) বেশি থাকে' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আশা করি চসিক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।'
কর্তৃপক্ষ যা বলছেন
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'মশার প্রজনন স্থানগুলোতে চসিক কর্মীরা ওষুধ ছিটাচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়; যেমন ছাদ, বাগানের টব, পরিত্যক্ত পাত্র, নির্মাণাধীন ভবন এবং বাড়ির উঠোনে। মানুষকে তাদের আশপাশ পরিষ্কার করতে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।'
রেজাউল বলেন, 'চসিক একা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারবে না; এ বিষয়ে গণসচেতনতা জরুরি। তাই আমাদের নিজ নিজ বাড়ি ও উঠান পরিষ্কার রাখতে হবে।'
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ইতোমধ্যে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জরিপ শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, 'এই জরিপে খুলশী, সদরঘাট, ফিরিঙ্গি বাজার, উত্তর কাট্টলী, দক্ষিণ কাট্টলী, আকবর শাহ, কর্নেল হাট, শুলক বহর ও চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ডেঙ্গুর হটস্পট সম্পর্কে চসিককে জানিয়েছি।'
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজল হক শাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা নগরীতে রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশার ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে জানতে হটস্পট থেকে লার্ভার নমুনা সংগ্রহ করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'এ নমুনাগুলো রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে।'
Comments