‘ওয়াসা তাকসিমের কাছে সোনার খনি, আরও ১৪ বছর থাকতে চান তিনি’

তাকসিম
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নাগরিক সেবার মান নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি দুর্নীতি, অনিয়মসহ অজস্র অভিযোগ থাকার পরও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে আরও ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তাকসিম এ খান।

গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ওয়াসার বোর্ড সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ওয়াসা আইন ভঙ্গ করে 'ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায়' ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা করে ঢাকা ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় আর দুর্নীতির 'আখড়ায়' পরিণত করার অভিযোগও আছে তাকসিমের বিরুদ্ধে। তাই এতকিছুর পরও ঢাকা ওয়াসা বোর্ড কেন তাকসিমকে একই পদে রাখার প্রস্তাব করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদ ও ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হকের সঙ্গে।

এ বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'তাকসিম এ খানকে নিয়ে ইতোমধ্যেই অভূতপূর্ব একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। যদি গভীরে যাওয়া যায়, ওয়াসা এমডির আগের সব নিয়োগই নিয়ম বহির্ভূত। অনিয়মের মাধ্যমেই সেটা হয়েছে। প্রতিবারই যখন তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সেটা নিয়ম ভঙ্গ করেই হয়েছে।'

'প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ও জনস্বার্থকে ব্যাহত করে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভূতপূর্ব সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। আর এই অনিয়ম-দুর্নীতির বোঝা শেষ পর্যন্ত বইতে হচ্ছে জনগণকেই।'

তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট সব প্রমাণ এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও তাকে পুনরায় এমডি পদে নিয়োগে সুপারিশ করার বিষয়টি খুব 'হতাশাজনক' মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, 'তিনি আবার নিয়োগ পেলে জনগণও হতাশ হবে। দৃশ্যত যেটা মনে হচ্ছে- তার ক্ষমতার খুঁটি এতই বেশি শক্তিশালী যে তিনি যে অবস্থানে আছেন, সেখান থেকে নড়চড় করার কোনো সুযোগ বোধহয় বাংলাদেশ সরকারের নেই।'

তাকসিম পুনরায় ওয়াসার এমডি হলে দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও খুব নেতিবাচক একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এটা যে বার্তাটা দিচ্ছে তা হলো- কোনো ধরনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করেই স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে জনগণের ওপরেই সেই অনিয়মের বোঝা চাপিয়ে দিয়েও বিচারহীন থাকা যায়।'

'আবার এর মাধ্যমে পুরো সমাজকেও এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, দুর্নীতি-অনিয়ম কিংবা স্বেচ্ছাচারিতার মতো অপরাধ কোনো বিষয় না। এগুলো করেও পার পাওয়া যায়।'

২০০৯ সালে তাকসিমকে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় ৫ দফা। ষষ্ঠ দফায় পাওয়া তার নিয়োগের মেয়াদ আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা।

নতুন করে তার মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, 'একই ব্যক্তিকে এতবার নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে কথা বলার কোনো কারণই নেই। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তখনই উন্নতি হয়, যখন তার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থাকে। এর মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়, দক্ষতা তৈরি হয়। কিন্তু একই মানুষকে বার বার একই পদে রাখার অর্থ নিচের লোকজনের ডিমোটিভেটেড হয়ে যাওয়া।'

এই নগর পরিকল্পনাবিদের ভাষ্য, 'তাকসিম এ খানের এমন কোনো সাফল্য নেই যে তিনি সুপারম্যান হয়ে গেছেন। ঢাকায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় যতটুকু সাফল্যের কথা বলা হয়, সেটুকু ওয়াসারই দাবি করা। কিন্তু একটু ক্রিটিক্যালি দেখতে গেলে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ওয়াসার যে ডিপেন্ডেন্সি তারা সেটা কমাতে পারেনি বহু বছরেও।'

'সারফেস ওয়াটারের নতুন সোর্স খুঁজে বের করা, সেগুলো ট্রিটমেন্ট করা, সেখান থেকে সরবরাহ বাড়ানো- এমন টেকসই কোনো ব্যবস্থাপনা ওয়াসা করতে পারেনি। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সাফল্য নেই। সুতরাং যতটুকু সাফল্য ওয়াসা দাবি করে, সেটাও আনসাসটেইনেবল একটি অ্যাপ্রোচ।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'বড় বড় প্রজেক্ট নিয়ে অনেক দূর থেকে তারা (ওয়াসা) পানি নিয়ে আসতেছে। এর মূল্য শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হচ্ছে। প্রকল্পনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে ওয়াসা। তাদের আরেকটা কাজ যে পয়ঃনিষ্কাশন- সেখানে তাদের কোনো সাফল্যই নেই।

'দাসেরকান্দিতে একটা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করেছে ওয়াসা। বেগুনবাড়ি কিংবা হাতিরঝিল ছাড়া অন্য এলাকার সঙ্গে এর কোনো সংযোগ লাইনই নেই। অথচ এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গুলশান, বনানী, মালিবাগ, মগবাজারের মতো এলাকাগুলোর পয়ঃবর্জ্য এখান থেকে যাবে। আজকে থেকে শুরু হলেও এই লাইনগুলো তৈরি হতে আবার ১০-১৫ বছর লেগে যাবে। তাহলে এটা কেন ভাবা হচ্ছে যে এই লোক ছাড়া ওয়াসা চলবে না?'

তাকসিম এ খানের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে সম্প্রতি বিদায় নিতে হয়েছে সংস্থাটির বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফাকে। এছাড়া এমডি হিসেবে তাকসিমের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ২০২২ সালে হাই কোর্টে একটি রিট মামলা করে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৭ অগাস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন, তাকসিম এ খান গত ১৩ বছর ধরে বেতন-ভাতা বাবদ কত টাকা নিয়েছেন, সেই হিসাব ৬০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে হবে।

সেইসঙ্গে তাকসিম এ খানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাকে অপসারণে বিবাদীদের 'নিষ্ক্রিয়তা' কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

তাকসিম এ খান সম্পর্কে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হকের পর্যবেক্ষণ হলো, 'তাকসিম এ খান ওয়াসাতে ১৪ বছর ধরে আছেন। উনি আরও ১৪ বছর থাকতে চান। এত সমালোচনা স্বত্বেও একই সংস্থায় একই পদে এভাবে থাকতে চাওয়ার প্রধান কারণ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ। উনি এখানে সোনার খনির সন্ধান পেয়েছেন। এই লোভে উনি চেয়ার ছাড়তে চান না।'

মোজাম্মেল হক বলেন, 'আরেকটা কারণ হলো পদ্মা প্রজেক্ট, দাসেরকান্দি প্রজেক্ট, সাভারের ভাকুর্তা প্রজেক্টের মতো প্রকল্পগুলোতে উনি এত বেশি দুর্নীতি করে ফেলেছেন যে উনি চেয়ার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সবকিছু ওপেন হয়ে যাবে। জনগণ, সরকার এগুলো জানবে। এবং কীভাবে উনি এসব দুর্নীতি চালিয়ে গেছেন সেগুলো সবাই আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে। তাই এটা যতদিন সম্ভব, যতভাবে ঠেকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা উনি চালিয়ে যাচ্ছেন।

'এই (এমডি) পদে থাকার জন্য উনি বোর্ড চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যদের ম্যানেজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ আছে। সেটাও উনি ম্যানেজ করে ফেলবেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো বোঝানো হবে বোর্ড তাকে চায়, মন্ত্রণালয়ও চায়।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Climate debt in Bangladesh from 2009 to 2022

Bangladesh’s climate debt keeps climbing

As global leaders gather in Baku, Azerbaijan to discuss finance at the 29th climate conference, the most vulnerable countries like Bangladesh are demanding new and additional climate finance that does not exacerbate climate debt.

11h ago