আমরা শান্তি চাই, কিন্তু যা কিছু করি যুদ্ধের জন্য করি: ড. ইউনূস

‘এবার শান্তির দিকে তাকান। যেটা দুনিয়ার মুখ্য বিষয়, সেটার জন্য কিছুই নেই। শান্তি মন্ত্রণালয় বলে দুনিয়াতে কোনো মন্ত্রণালয় নেই। শান্তি চাইতে হলে তার জন্য কাজ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে, ফ্রেমওয়ার্ক বানাতে হবে। সেটা নেই।’
মালয়েশিয়ায় ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৩’র অনুষ্ঠানে কথা বলছেন ড. ইউনূস। ছবি: গোলাম মোর্তোজা/স্টার

'সবাই শান্তি চাই। কিন্তু শান্তির জন্য কিছু করি না। আমরা যা কিছু করি, যুদ্ধের জন্য করি'—'সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৩' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আজ সকালে কথাগুলো বলছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে 'সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৩' এর আয়োজন। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় 'ওয়ার, পিস অ্যান্ড ইকোনমিকস—ফিউচার অব হিউমেন বিয়িংস' বা 'যুদ্ধ, শান্তি ও অর্থনীতি—মানব জাতির ভবিষ্যৎ'।

ড. ইউনূসের জন্মদিন ২৮ জুন। তিনি জন্মদিন পালন করেন না। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ২৭-২৮ জুন ইউনূস সেন্টারের উদ্যোগে উদযাপন করা হয় 'সোশ্যাল বিজনেস ডে'। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন দেশে দিবসটির আয়োজন করা হয়। যে দেশে উদযাপন করা হয়, সে দেশের এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকে মূল আয়োজক। সহযোগিতা করে ইউনূস সেন্টার।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা। ছবি: স্টার

এবারের 'সোশ্যাল বিজনেস ডে'র আয়োজক দেশ মালয়েশিয়া। আয়োজনের স্থান লঙ্কাভি। মূল আয়োজনটি করছে 'আলবোখারি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি'। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ড. ইউনূস। এ বছর কোরবানির ঈদের কারণে জুনের পরিবর্তে ২৭-২৮ জুলাই দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় ৪০ দেশ থেকে ৭০০ অতিথি এবারের আয়োজনের অংশগ্রহণ করেছেন। এবারের রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল ২৫০ ডলার।

অনুষ্ঠানে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'ওয়ার, পিস ও ইকোনমিকসের মধ্যে সম্পর্ক কী এবং ভবিষ্যতে মানুষের কপালে কী আছে? সবকিছুর গোঁড়া হচ্ছে ইকোনমিকস। যুদ্ধ সৃষ্টি করছে ইকোনমিকস, আবার শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ইকোনমিকসই করতে পারবে।'

'এই সম্পর্কের মধ্যে গোলকধাঁধা দেখা দেওয়াতেই মানুষের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে গেছে, মানুষ এখন সমাপ্তির পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে—যেখানে তার ইতিরেখা দেখা যাচ্ছে, বেশি দূরে নেই,' যোগ করেন তিনি।

এই আয়োজনে স্পিকার হিসেবে রয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ, কলামিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট মেরিনা মাহাথির, নারায়ণ হৃদয়ালয়ের চেয়ারম্যান ডা. দেবী প্রসাদ শেঠি, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী লেমা বোউই, পূর্ব তিমুরের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হোসে রামোস হোর্টা, ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী মেরিনা সিলভাসহ আরও অনেকে। মাহাথির বিন মোহাম্মদ আগামীকাল আয়োজনের প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর তার বক্তব্য রাখবেন।

নতুন নতুন টেকনোলজি আসছে। এই যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির কথা বলছি, তার আগে আমরা মহাজগতের জন্য টেকনোলজি করেছি—এগুলো কোথা থেকে আসছে? সব আসছে ডিফেন্স রিসার্চ থেকে। ডিফেন্স রিসার্চের প্রয়োজনেই আমাদের এদিক-সেদিক যেতে হচ্ছে যে মানুষ মারার জন্য কোন কল-কবজা করতে হবে। এত নতুন নতুন টেকনোলজি তৈরি হচ্ছে, কারণ টাকা ঢালছে। এটা করছে মানুষ মারার জন্য। এই রিসার্চ, এই প্রতিষ্ঠান, এই গবেষণা, মানুষ ডাকা—এর কোনোটাই শান্তির জন্য নেই।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পর দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে গিয়ে এ বছরের আয়োজক দেশ বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'মালয়েশিয়ার মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। যেমন: মাহাথির বিন মোহাম্মদ আমাকে আগে থেকেই বলেছিলেন যে তিনি উপস্থিত থাকবেন এবং আমাদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। তিনি বক্তৃতা দিয়ে চলে যাবেন না। তিনি এখানে থাকবেন, আমাদের সঙ্গে সময় কাটাবেন, নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো বলবেন।'

'আমরা এবার যেখানে সোশ্যাল বিজনেস ডে পালন করছি, এটা মাহাথির বিন মোহাম্মদের জন্মভূমি। তিনি মনে করেন যে, "আমার বাড়িতে আসছেন আপনারা, কাজেই আমি থাকব আপনাদের সঙ্গে",' যোগ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সামাজিক ব্যবসার দিকপাল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়ে বিশদ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সবাই শান্তি চাই। সবাই শান্তির জন্য সবকিছু করতে পারি বলে মুখে ফেনা তুলতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো উদ্যোগ নিতে রাজি নই। আমরা শান্তির ব্যাপারে কোনো কাজ করি না, শুধু মুখে কথা বলি। আমরা যা কিছু করি, যুদ্ধের জন্য করি। যুদ্ধের জন্য কেন করি? দুনিয়ার প্রত্যেকটা দেশে একটি ওয়ার মিনিস্ট্রি আছে, যেটাকে আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলি। আসলে যুদ্ধের প্রস্তুতি হলো ওই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।'

অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসের সঙ্গে অন্য অতিথিরা। ছবি: স্টার

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বার্ষিক বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ডিফেন্স বাজেট বেশ মোটাসোটা একটা বাজেট। মোটাসোটা তো বটেই, এটা নিয়ে কেউ প্রশ্নও করতে পারে না যে কী আছে এটার ভেতরে। এত কঠিন জিনিস এটা। আমরা কাউকে জানতে দিতে চাই না যে এটার ভেতরে কী আছে। মানুষ মারার যত রকমের পরিকল্পনা, তা এর ভেতরে আছে। যুদ্ধ মানেই হলো মানুষ মারা। মানুষ মারলে কীভাবে মারতে হবে, কত দ্রুত গতিতে মারতে হবে, শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, কার কতো শক্তি—সেটা এই যুদ্ধ বাজেটের ভেতর দিয়ে আমরা করি।'

তিনি বলেন, 'ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি আছে। পুরো ব্যবসা চলছে ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির। ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি সব সময় সাজসরঞ্জাম বানাচ্ছে মানুষ মারার, যুদ্ধ করার জন্য। তারা সাজসরঞ্জাম বানাতে নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করছে বলে ফিসফাস করে, "একটা যুদ্ধ হলে এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারতাম"। যুদ্ধ করার একটা আগ্রহ তাদের থাকে। তারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে যে "এটা যুদ্ধ দিয়ে শেষ করেন, এমনি পারবেন না। আমাদের কাছে আছে, ২ দিনে শেষ করে দেবো"। এভাবে উৎসাহ যোগাচ্ছে। যেহেতু তার টাকা-পয়সা আছে, বিলিয়নস অব ডলার এখানে জড়িত।'

শান্তির জন্য মন্ত্রণালয় আছে কি না প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'এবার শান্তির দিকে তাকান। যেটা দুনিয়ার মুখ্য বিষয়, সেটার জন্য কিছুই নেই। শান্তি মন্ত্রণালয় বলে দুনিয়াতে কোনো মন্ত্রণালয় নেই। শান্তি চাইতে হলে তার জন্য কাজ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে, ফ্রেমওয়ার্ক বানাতে হবে। সেটা নেই।'

সবাই শান্তি চাই। সবাই শান্তির জন্য সবকিছু করতে পারি বলে মুখে ফেনা তুলতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো উদ্যোগ নিতে রাজি নই। আমরা শান্তির ব্যাপারে কোনো কাজ করি না, শুধু মুখে কথা বলি। আমরা যা কিছু করি, যুদ্ধের জন্য করি। যুদ্ধের জন্য কেন করি?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শান্তি তো আর মুখের কথায় আসবে না। টাকা-পয়সা লাগবে, তার জন্য একটা বাজেট দরকার। মারার জন্য বিরাট বাজেট করেছেন, কিন্তু শান্তির জন্য করেননি। অথচ, মারারটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে সেটা শান্তির জন্য করছেন। যুদ্ধ করছেন কী জন্য, শান্তি আনার জন্য। অদ্ভুত কথা। যুদ্ধ করে শান্তি আনা যায় নাকি?'

'শান্তির নিজস্ব একটা প্রক্রিয়া থাকবে। সেই প্রক্রিয়া আমরা শুরু করিনি। আমরা শান্তির মন্ত্রণালয়ও করিনি, শান্তির বাজেটও করিনি, শান্তির ইন্ডাস্ট্রিও পৃথিবীর কোথাও নেই। এই মন্ত্রণালয়ের জন্যও কেউ নেই, বুদ্ধি দেওয়ার মতোও কেউ নেই। এটা শোনার জন্য কারো গরজও নেই,' যোগ করেন তিনি।

আলবোখারি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'নতুন নতুন টেকনোলজি আসছে। এই যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির কথা বলছি, তার আগে আমরা মহাজগতের জন্য টেকনোলজি করেছি—এগুলো কোথা থেকে আসছে? সব আসছে ডিফেন্স রিসার্চ থেকে। ডিফেন্স রিসার্চের প্রয়োজনেই আমাদের এদিক-সেদিক যেতে হচ্ছে যে মানুষ মারার জন্য কোন কল-কবজা করতে হবে। এত নতুন নতুন টেকনোলজি তৈরি হচ্ছে, কারণ টাকা ঢালছে। এটা করছে মানুষ মারার জন্য। এই রিসার্চ, এই প্রতিষ্ঠান, এই গবেষণা, মানুষ ডাকা—এর কোনোটাই শান্তির জন্য নেই। শান্তির জন্য গবেষণাও নেই, শান্তির জন্য নতুন নতুন টেকনোলজিও নেই, শান্তির জন্য ইন্ডাস্ট্রিও নেই। যে জিনিসটা আপনারা চান, তার জন্য আপনাকে অর্থ দিতে হবে, জনবল দিতে হবে, ক্রিয়েটিভিটি দিতে হবে—তাহলেই আসবে। আপনি কোথা থেকে শান্তি পাবেন, যদি শান্তির জন্য এক পয়সাও না দেন?'

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা। ছবি: স্টার

তিনি আরও বলেন, 'ডিফেন্স মিনিস্ট্রি ছাড়াও প্রত্যেক ফরেন মিনিস্ট্রিতে মিলিটারি অ্যাটাশে থাকেন—একজন জেনারেল, বড় সামরিক কর্মকর্তা। তার কাজ ওই দেশের কাজকর্ম দেখা, সেগুলোর খবর দেওয়া, যুদ্ধের সময় পরস্পর সহযোগিতা করা, বা যুদ্ধের সময় আগে থেকে সব খবর সংগ্রহ করা। কিন্তু পিস অ্যাটাশে কোথায়? আমাদের পাশের দেশে একটা পিস অ্যাটাশে থাকত, কার সঙ্গে কাকে মিলালে শান্তি হবে, কোন পলিটিশিয়ান কলের মাধ্যমে বা কোনো সামাজিক রক্ষা কর্মীর মাধ্যমে শান্তি রক্ষা হবে, সেগুলো তারা দেখতো। সেটা তো করছে না। এটা মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমে হবে, নাকি অন্যভাবে হবে, তার রাস্তা বের করতে হবে। এই রাস্তার জন্য একটা কাঠামো লাগবে।'

'আমরা অর্থনীতি সৃষ্টি করেছি মুনাফা এবং যুদ্ধের জন্য, শান্তির জন্য আমরা কিছুই করিনি' উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'এ জন্যই বলছি, আমাদের গোড়াতে ফিরে যেতে হবে। শান্তির জন্য একটা নতুন ইকোনমি সৃষ্টি করতে হবে এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন লাগবে, আর্থিক অ্যালোকেশন লাগবে, গবেষণা লাগবে। তাহলে শান্তি আসবে।'

'এগুলো নিয়েই আমরা সোশ্যাল বিজনেস ডে-তে আলোচনা শুরু করেছি এবং আগামীকালও করব। সামাজিক ব্যবসা শান্তির সপক্ষে কীভাবে কাজ করতে পারে, সেটা আলোচনা হচ্ছে। যেহেতু টাকা রোজগারের কোনো ব্যাপার নেই এখানে, তাই সামাজিক ব্যবসাটা শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেটা শুধু একটি দেশের জন্য না, মানুষের মঙ্গলের জন্য আমরা করি। চাইলে একটি দেশ আরেকটি দেশে সেটা নিয়ে আসবে, যাতে মানুষ সন্তুষ্ট থাকে এবং পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধের কোনো ব্যাপার আর না থাকে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

20h ago