মাখোঁকে একতারা উপহার দিয়ে কলম পেলেন রাহুল
গানের দল 'জলের গান'র সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী রাহুল আনন্দের ধানমন্ডির বাসায় নিজস্ব স্টুডিওতে সময় কাটিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
রাহুলের স্টুডিওতে বসে তিনি গান শুনেছেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে জেনেছেন। সেই সঙ্গে উপহার দিয়েছেন, পেয়েছেন।
আজ সোমবার রাত পৌনে ১২টার দিকে রাহুল আনন্দের বাসায় যান মাঁখো। সেখানে তিনি প্রায় এক ঘণ্টা বাংলার লোক-ঐতিহ্যের আবহে ডুবে ছিলেন।
অনন্য এই অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন রাহুল আনন্দ।
তিনি বলেন, 'ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আসবেন, এটা তো জানে সবাই। আমাকে ৭ দিন আগে দূতাবাস থেকে জানানো হলো যে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তারা জানালো, প্রেসিডেন্ট আমাকে ব্যাপারে কৌতূহলী।'
তিনি আরও বলেন, 'কিছুদিন আগে ফরাসি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে একটা আর্ট কোলাবরেশন হয়েছিল। একজন মিউজিশিয়ান এসেছিলেন, নাম ম্যাক্স। তিনি ফরাসি, কিন্তু এখন বেলজিয়ামে থাকে। আমরা দুজন মিলে কোলাবরেশন করেছি। আমি অনেক বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছিলাম সাইকেলের নানান যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। সেখানে আমি ওগুলো বাজাই। ওটা কোনোভাবে প্রেসিডেন্টকে আকৃষ্ট করে। তারপরে তিনি আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন। আমি নিজেই বাদ্যযন্ত্র বানাই এবং সেই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মঞ্চে গান করি—এগুলা জেনে হয়তোবা তিনি কৌতূহলী হয়েছেন।'
ফরাসি প্রেসিডেন্ট যে তার বাড়িতে কিংবা স্টুডিওতে আসতে চাইবেন, তা ধারণাও করতে পারেননি রাহুল।
তার ভাষ্য, 'আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, প্রেসিডেন্ট দেখা করবেন। কোথাও গিয়ে আমাকে দেখা করতে হবে। যা হয়—ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার অবস্থাও তো তাই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন আসেন, তাদের সামনে আমাকে নিয়ে "এই হচ্ছে আমাদের রাহুল, ও গান করে। এই রাহুল, একটা গান গাও দেখি...", পরে রাহুল তার দলবল নিয়ে একটা গান গায়। আমি ভেবেছিলাম ওরকমই কোনো একটা সাক্ষাৎ।'
কিন্তু ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিজেও একজন সংগীতশিল্পী, তাই রাহুলের সঙ্গে তিনি বাড়িতেই সময় কাটাতে চাইলেন।
রাহুল বলেন, 'তিন দিন আগে আমি জানলাম, তিনি আমার বাসায় আসতে চান। তখন আমি আসলে অসহায় বোধ করলাম। আমি একটা ভাঙা বাড়িতে থাকি, পুরোনো বাড়ি। এখানে তাকে আমি কীভাবে আপ্যায়ন করবো? আমার তো আসলে সামর্থ্য নেই ওরকম। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা আসলেন। আমার বাসার ছবি-টবি ইতোমধ্যে তাদের কাছে আছে। তিনি আমার বাসাতেই আসতে চান। আমার বাদ্যযন্ত্র দেখতে চান। আমি কীভাবে বানাই, কীভাবে বাজাই—দেখতে চান।'
বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে বাংলার রীতিতেই নিজ বাড়িতে বরণ করে নিয়েছেন রাহুল।
তার ভাষায়, 'একেবারে বাঙালিরূপে বাড়িতে একজন বিশেষ মানুষ এলে যেভাবে আমরা বরণ করি, সেভাবেই ফুল দিয়ে বরণ করেছি। দোকান থেকে ফুলের তোড়া কিনে আনিনি। যেহেতু আমরা স্বামী-স্ত্রী চারুকলার শিক্ষার্থী ছিলাম—আমরা নিজেরাই আমাদের মাটির যে পটারি, সেভাবে মাটির পাত্রে ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে তাকে বরণ করে নেই, বাসার ভেতরে নিয়ে যাই।'
'তিনি নানান বাদ্যযন্ত্র দেখে কৌতূহলী হন। এটা কী, কীভাবে বাজায়—এমন প্রশ্ন করতে চান। তিনি বাঁশি দেখিয়ে শুনতে চেয়েছেন। আমি তাকে প্রায় ৫ মিনিটের মতো বাঁশি বাজিয়ে শোনাই। আমার কাছে মনে হয়েছে একজন সংগীতশিল্পীর বাড়িতে আরেকজন সংগীতশিল্পী এসেছেন। আমি এটা তাকেও বলেছি,' বলেন রাহুল।
ফরাসি প্রেসিডেন্টকে একতারা উপহার দিয়েছেন রাহুল। অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে একতারা বাজাতে হয় সেটি শিখিয়েও দিয়েছেন, সঙ্গে গান করেছেন।
রাহুল বলেন, 'আমার নিজের বানানো একটা একতারা উপহার দিয়েছি। তিনি ওটার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি তাকে একতারার ইতিহাস বললাম। কীভাবে বাজায় দেখালাম, বাউলরা কীভাবে একতারা বাজিয়ে গান করেন সেটাও দেখালাম। আমি একটু লালন সাঁইজির গান শোনালাম। আমি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের "আমি বাংলায় গান গাই" গানের কয়েকটা লাইন গেয়ে শোনালাম। তিনি একতারা কীভাবে বাজায় শিখতে চাইলেন। আমি শেখালাম। তিনি যেহেতু সংগীতশিল্পী, খুব অল্প সময়ের মধ্যে পুরোটা শিখে গেলেন।'
'শেখার পর তিনি একতারা বাজালেন, আমি গান ধরলাম। "নাইয়া রে" গানটা করলাম। আমি বললাম, আমি এটাই চাই, পৃথিবীটা এরকম হোক। আমি বাংলাদেশের একজন সংগীতশিল্পী। তিনি ফ্রান্সের একজন সংগীতশিল্পী। যদিও আমি একজন সাধারণ মানুষ আর তিনি প্রেসিডেন্ট, কিন্তু আমরা একসঙ্গে গাইছি, একসঙ্গে বাজাচ্ছি, আমি এটাকে কোলাবরেশন মনে করি। আমি এটাকেই কালচারাল অ্যাপ্রিসিয়েশন মনে করি,' বলেন রাহুল।
রাহুলের কাছে তার স্বপ্ন, ইচ্ছার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন মাঁখো। রাহুল বলেছেন, তিনি একটি সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন।
'তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, এই স্বপ্ন পূরণে আমি কী করছি। আমি বললাম, আমি বাদ্যযন্ত্র বানাই। আমার কাঠ দরকার হয়, তাই আমার গাছ লাগবে। সে কারণে আমি অনেক আগে থেকে, ১৯৯৪ সাল থেকে যেখানেই খালি জায়গা পাই সেখানে গাছ লাগাই। সেটা আমার জায়গা হোক, সরকারি হোক, বেসরকারি হোক। আমি চারুকলার আঙ্গিনা থেকে শুরু করে সব জায়গায় গাছ লাগাই। এই বর্ষাতেও আমি অন্তত ৫০টার ওপরে বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছি। এটা আমি নিজ দায়িত্বে আমার মতো করে করি।'
'চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে আমি খালি জায়গাতে গাছ লাগাই। কয়েকদিন আগে আমি আগরতলা সীমান্ত পার করার সময় কমপক্ষে ১০০ গাছ লাগিয়ে এসেছি। এটা শুনে তিনি খুব প্রশংসা করলেন। আমি একটা ভূমিকা রাখছি এই পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য—সেটার প্রশংসা করলেন। আমি বললাম, "মি. প্রেসিডেন্ট, আমার এতো স্বপ্ন। স্বপ্নের কারণে আমি ঘুমাতে পারি না। জেগে থেকেই স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্নের কোনো শেষ নেই। আমার স্বপ্ন, আমি বাংলা গানটা গাইতে চাই। আমার মানুষকে আমি সুখি দেখতে চাই"।'
রাহুলের সাইকেলের প্রকল্পের বিষয়েও জানতে চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাঁখো। 'আমি তখন বললাম, আমার একটা ক্ষুদ্র ইচ্ছা ছিল যে আমি সাইকেল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করব। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারপর আমি ভাবতে শুরু করলাম, সাইকেলকে কী করে বাদ্যযন্ত্রে রূপান্তর করা যায়। কারণ, এখন আমি বিভিন্ন জায়গায় গান করতে যাচ্ছি। আমি এখন ভ্রমণ করছি গানবাজনার কারণে। সাইকেল দিয়ে কী করে আমি আরও বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে পারি, সেই সাইকেল নিয়ে কীভাবে আমি মিউজক্যালি ভ্রমণ করতে পারি, এই ভাবনা থেকেই বিষয়টি এসেছে।'
প্রেসিডেন্ট মাঁখো অনেক প্রশ্ন করলেও তার কাছে কিছু জানতে চাননি রাহুল। তিনি বলেন, 'আমি তার কাছে কোনো কিছু জানতে চাইনি। তিনি যা জানতে চেয়েছেন, আমি বলেছি। তথ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু তিনি আমার দেশের মন্ত্রী, তাকেও আমি এড্রেস করেছি। প্রেসিডেন্ট অনেক কৌতূহলী ছিলেন। আমার তাকে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, আপনি প্রেসিডেন্ট অবশ্যই কিন্তু আমি একজন সংগীতশিল্পী মনে করেই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। দুই সংগীতশিল্পীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে।'
এত কম সময়ে আসলে আমরা বেশি কিছু করতে পারিনি। ৩ দিন আগে জানতে পেরেছি তিনি বাসায় আসবেন। ঘর গোছাইতেই তো সময় লেগে গেছে।
প্রেসিডেন্ট মাঁখো যে কলমে লেখেন, সেইরকম একটি কলম রাহুলকে উপহার দিয়েছেন। তার দেওয়া কলমে রাহুল লিখবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নিয়েছেন।
রাহুল বলেন, 'তিনি আমার কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বারবার জানতে চেয়েছেন আমি কিছু চাই কি না। আমি বলেছি, আমি কিচ্ছু চাই না। আমার ভেতরে একটা খাঁচাবন্দি পাখি আছে। আমি চাই পাখিটা মুক্ত হোক। উড়ুক, গান করুক, বাঁচুক। এ জন্য আমি গান গাই। এসব শুনে তিনি আমাকে একটা কলম দিলেন। অসাধারণ সুন্দর একটা কলম। কলমের নিবটা গোল্ড প্লেটেট। তিনি বললেন, এটা আমার পক্ষ থেকে একটা বিশেষ উপহার। আমিও এই কলমটা দিয়েই লিখি। তুমি প্রমিজ করো যে এই কলমটা দিয়ে গান কিংবা কবিতা লিখবে। প্রকৃতি ও মানুষের কথা লিখবে।'
'তিনি আমাকে প্রমিজ করেছেন, "আমি কিন্তু একদিন তোমার কাছে এই কলম দিয়ে লেখা গান কিংবা কবিতা শুনতে চাই।" আমি তাকে কথা দিয়েছি যে আমি লিখবো। আমার স্ত্রী একেবারেই আমাদের গ্রামের নারীদের করা নকশী কাঁথার ফোড়নে একটা বাংলাদেশের ম্যাপ তৈরি করেছে তার জন্য। সেটি উপহার দিয়েছে। এত কম সময়ে আসলে আমরা বেশি কিছু করতে পারিনি। ৩ দিন আগে জানতে পেরেছি তিনি বাসায় আসবেন। ঘর গোছাইতেই তো সময় লেগে গেছে,' বলেন রাহুল।
Comments