‘মনোটোনাস’ ঢাকায় ‘রোদন-রূপসী’ বৃষ্টি যেভাবে ‘সন্ত্রাস’ হয়ে নামে

‘শহরে বৃষ্টি জলকাদা মাখা নোংরা দেদার’। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

বিশিষ্ট লেখক-ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই সত্তর-আশির দশকের ঢাকাকে একইসঙ্গে 'মনোরম' ও 'মনোটোনাস' অভিধা দিয়েছিলেন। তার প্রথম প্রকাশিত গল্প 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'র শুরুতে ঘোরগ্রস্ত যুবক রঞ্জুর জবানিতে তিনি বলেছিলেন, 'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, "তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।"'

এই গল্পে ইলিয়াস বৃষ্টিকে ডেকেছিলেন 'রোদন-রূপসী' নামে। কিন্তু এখন এই ২০২৩ সালে এসে ইলিয়াসের ওই গল্পের সঙ্গে সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় ছল ছল শব্দ করে রিকশা কিংবা গাড়ি চলতে দেখার মিলটুকুর বাইরে ঢাকা শহরকে অন্তত মনোরম বলার কোনো উপায় নেই।

এমনিতে বৃষ্টির সঙ্গে মানুষের আবেগের একটি জোরালো সম্পর্ক আছে। তার ওপর প্রায় দুই কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট 'বারোমাসি' গরমের এই ঢাকা মহানগরে বৃষ্টির ধারা এখানকার বাসিন্দাদের মনে অনেকটা স্বস্তির পরশ নিয়ে আসে। তাই দেশের খ্যাতনামা কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের রচনায় শহুরে বৃষ্টি নিয়ে বিস্তর উচ্ছ্বাসও লক্ষ্য করা যায়।

তবে ধারার বিপরীতে এই শহরে বৃষ্টির পতনকে 'সন্ত্রাসের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন কবি শহীদ কাদরী। তার বিখ্যাত সেই 'বৃষ্টি, বৃষ্টি' শিরোনামের কবিতায় যেমন পাওয়া যায় শহুরে মানুষের একাকিত্ব ও বিলাপের ছায়া; তেমনি পাওয়া যায় অবশ্যম্ভাবী প্লাবনে ভেসে যাওয়া সভ্যতার উদ্দাম ও অনিশ্চিত যাত্রার চিত্রকল্প।

যে ভোগান্তির শেষ নেই। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

শহীদ কাদরী সেখানে লেখেন, 'সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে/যারা তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো, চৌদিকে/ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মত যেন বা মড়কে/শহর উজাড় হবে,– বলে গেল কেউ– শহরের/পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়'।

তাই হয়তো বলাই যায় যে, এই শহরে বর্ষাযাপনের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বৃষ্টির আটপৌরে রোমান্টিক ইমেজের বাইরে যেন এর 'সন্ত্রাস' তৈরির ইমেজটাকেই বেশি জাঁকিয়ে তোলে।

সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় বৃষ্টি ঝরছিল দুপুর থেকেই। বিকেলে এর বেগ আরও বাড়ে। সন্ধ্যার আগেই রাতের ঘোর অন্ধকার নেমে যায় চারদিকে। সঙ্গে ছিল খানিক ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি।

পাঁচটার দিকে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের ষষ্ঠ তলার লাউঞ্জ থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের দিকে তাকিয়ে গেল, শহরের ব্যস্ততম এই সড়কের দুই পাশেই স্থবির হয়ে আছে শত শত প্রাইভেট কার, বাস, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন। এসব বাহনে আটকে পড়া অসহায় যাত্রীদের চোখের সামনে দিয়ে বৃষ্টিতে বিপদসংকুল হয়ে ওঠা রাজপথে ছাতা মাথায় হাজারো মানুষের উদ্বিগ্ন পদযাত্রাও চোখ এড়ায় না। 

এর ভেতরেই লাউঞ্জে গল্পরত এক সহকর্মীর মোবাইলে আসে মায়ের উদ্বিগ্ন কল। ওই মাকে বলতে শোনা যায়, 'সাবধানে ফিইরো। বাতাস হচ্ছে। তার-টার ছিঁড়ে পড়ল কিনা খেয়াল রাইখো।'

সহকর্মীর মায়ের সঙ্গে তার কথোপকথনের এই অংশটুকু চকিতে মনে করিয়ে দেয় সপ্তাহদুয়েক আগের আরেক বৃহস্পতিবারের রাতের কথা। মহাজলজটে ঢাকায় 'দোজখ' নেমে আসা ওই রাতে সড়কে আটকা পড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান নগরবাসী। পানিতে তলিয়ে থাকা রাস্তায় কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। অসহায় হয়ে পড়েন পথচলতি মানুষেরা।

দুর্যোগের সেই রাতে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘরে মিরপুরে। কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাদের তিনজনই মারা যান। ওই পরিবারের সাত মাস বয়সী এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুকে কাছে টেনে নেন আরেক তরুণ সিএনজি চালক।

স্থবির রাজপথ। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

লেখক-গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা 'বারোটা বাজানো' সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে সাম্প্রতিক এক লেখায় উল্লেখ করেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ওই মৃতদের মরদেহ দেখে ঢাকায় পড়তে আসা এক বিদেশি শিক্ষার্থী রাতটিকে অভিহিত করেছিলেন 'ব্ল্যাক থার্সডে' নামে।

ওই ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় লঘুচাপের সঙ্গে মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তার প্রভাবে আরেক বৃহস্পতিবারের বৃষ্টি প্রায় তেমন পরিস্থিতিই তৈরি করল যেন।

এদিন বৃষ্টি থেমে আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিকেলে সাড়ে ছয়টার পর আরেক বন্ধু-সহকর্মীকে নিয়ে ডেইলি স্টার সেন্টার থেকে 'নরক' হয়ে ওঠা সড়কে নেমে নিজেদের ঝাঁকবাঁধা তেলাপোকার চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। জল আর জটে নাকাল হতে হতে কোনোভাবে পায়ে হেঁটে ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছাতে দেখা গেল—ফার্মগেট মোড় থেকে বিজয় সরণি মোড় পর্যন্তও একই অবস্থা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে র‌্যাম্পটি ফার্মগেট এলাকায় নেমেছে, সেখান থেকে খেজুরবাগান মোড় হয়ে রোকেয়া সরণি এবং পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউজুড়ে গাড়ির আর মানুষের জট। খেজুরবাগান মোড় থেকে খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেটমুখী সড়কের অবস্থাও একই।

এখান থেকে রোকেয়া সরণির ফুটপাত ধরে থেমে থাকা যানবাহন থেকে নেমে কিংবা রিকশা না পেয়ে নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটতে থাকা আরও অনেক পথচারীর সঙ্গে যেতে যেতে দেখা গেল, ফুটপাতের একটা বড় অংশজুড়ে নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা। বাধ্য হয়ে জল ছপ ছপ রাস্তায় নেমে হাঁটা শুরু করতেই খানিকক্ষণের জন্য গতি পাওয়া কয়েকটি গাড়ির চাকা ভিজিয়ে দিয়ে গেল পদচারীদের পোশাক। এদের মধ্যে দুই জন আতঙ্কে পড়েও গেলেন রাস্তার ওপর।

গাড়ি নড়ে না। ছবি: মাহবুব আলম

জাতীয় সংসদ ও চন্দ্রিমা উদ্যানের মধ্যবর্তী সড়ক এবং এখান থেকে বিজয় সরণির দিকে চলে যাওয়া সড়কটিও ছিল স্থবির। আবার আগারগাঁও মোড় থেকে মহাখালীর দিকে চলে যাওয়া বাইপাস সড়কটিরও ছিল একই দশা। সবমিলিয়ে মনে হয় পুরো শহরটিই যেন থেমে আছে।

এভাবে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট থেকে রোকেয়া সরণি ধরে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতে লেগে গেল ঘণ্টাখানেকের মিনিটের মতো। মাঝে শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটির সংলগ্ন যাত্রী ছাউনির কাছে এক নারীকে রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি করতে দেখা গেল। ওখান থেকে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্ত্বর পর্যন্ত যেতে রিকশাচালক ওই নারীর কাছে ২২০ টাকা ভাড়া চাইলেন। ভাড়া শুনে অস্ফুটে ওই নারীকে বলতে শোনা গেল, 'ডাকাত নাকি?'

শেষমেষ আগারগাঁও মোড় থেকে শামীম সরণি পর্যন্ত একটি রিকশা যেতে রাজি হলো ৫০ টাকায়। কিন্তু শামীম সরণিতে ঢোকার মুখে দেখা গেল, ওয়াসার লোকজন রাস্তাটি খুঁড়ে রাখায় কাদামাটিতে মাখামাখি ওই সড়ক দিয়ে পায়ে হেঁটে চলার উপায়ও নেই।

পরে আরও অনেকখানি পথ ঘুরে বিকল্প আরেকটি রাস্তা দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা গেল, পানির নিচে চলে যাওয়া খোলা ম্যানহোলে চাকা বেধে আরোহী-চালকসহ একটি রিকশা উল্টে পড়ে গেছে। তখনই মনে পড়ে, সম্প্রতি এমন বৃষ্টির মধ্যেই চট্টগ্রামে নালায় পড়ে প্রাণ হারানো কলেজপড়ুয়া মেয়ে নিপা পালিতের কথা।

দিশেহারা যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ। ছবি: মাহবুব আলম

ঘরে ফিরে গা-গোসল সেরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ রাখি ফেসবুকের পাতায়। সেখানে 'ট্রাফিক এলার্ট' গ্রুপে মোহাম্মদ সজীব নামে একজন লেখেন, 'যাত্রাবাড়ী থেকে সাড়ে ৩টায় রওনা দিয়ে সাড়ে ৯টায় শেওড়াপাড়ায় এসে পৌঁছালাম।'

পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালগুলোতে টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যানবাহনের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে রাখা সড়কের গর্তে পানি জমে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার খবরও আসতে থাকে।

ঢাকা দূষণে 'সেরা' হওয়ার উদাহরণ তৈরি করেছে অনেক আগেই। ডেঙ্গু 'মড়কের' ভেতর সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের 'মর্যাদাও' কপালে জুটেছে এই নগরের।

এহেন পরিস্থিতিতে এমনিতেই 'মনোটোনাস' এই শহরে সবকিছু স্থবির করেও দেওয়া এমন বৃষ্টিকে 'সন্ত্রাস' ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

 

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago