‘বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ’

২০৮ খণ্ডে ৭৪ হাজার পৃষ্ঠায় বাঙালির ২০০ বছরের ইতিহাস

আজ শনিবার ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অতিকায় আকরিক এই গ্রন্থমালা প্রকাশের সূচনা হয়।
মোড়ক উন্মোচন পর্বে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ গ্রন্থমালার অন্য সম্পাদকরা। ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতি, ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি ও শিল্পসহ ১৬টি বিষয়ে বাঙালির গত ২০০ বছরের ভাবনাকে একত্রিত করার অংশ হিসেবে দুই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষীদের নির্বাচিত রচনা একত্রিত করে 'বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ' প্রকাশের সূচনা করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

আজ শনিবার ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অতিকায় আকরিক এই গ্রন্থমালা প্রকাশের সূচনা হয়।

এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই প্রকল্পের আওতায় মোট ১৬টি বিষয়ে ২০৮টি খণ্ডে গ্রন্থ প্রকাশিত হবে, যার মোট পৃষ্ঠা ৭৪ হাজারের বেশি। এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্বে ৫টি বিষয়ে ৫৪ খণ্ডের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হলো।

অনুষ্ঠানের সূচনায় ২৩ বছর আগে এই প্রকল্পের শুরু ও দীর্ঘ যাত্রাপথের গল্প শোনান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ইফতেখারুল ইসলাম জানান, ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে সবগুলো খণ্ড প্রকাশের কাজ শেষ হবে। ছাড়সহ সবগুলো খণ্ডের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। তবে কেউ যদি আগামী বছরের ৩০ মার্চের আগে সবগুলো খণ্ডের জন্য আগাম বুকিং দেন, তাহলে তা ৯০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব। সম্পূর্ণ সেটের পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক সেটের জন্যও আগাম বুকিং দেওয়ার সুযোগ আছে।

তিনি আরও জানান, এই গ্রন্থমালা নিয়ে একটি ওয়েবসাইটও তৈরি হয়েছে। https://bcrs.bskbd.org এই লিঙ্কে ক্লিক করলে   পাঠক, ক্রেতারা বই ও সম্পাদকদের সম্পর্কে সব তথ্য জানতে পারবেন, বই কিনতে পারবেন।

বিপুল এই গ্রন্থমালা সম্পাদনা করেছেন শিক্ষাবিদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার কাছ থেকে জানা যায়, প্রকল্পের অধিকাংশ প্রবন্ধই ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সংগৃহীত।  

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সংগৃহীত

এই কাজের জন্য ২০০ বছরের সময়সীমা বেছে নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'গত ২০০ বছর বাঙালি জাতির জীবনে এক অভাবনীয় বিকাশ ও সমৃদ্ধির যুগ বহমান ছিল। এ সময় বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বহুতর উত্থান-পতনের পাশাপাশি তার চিন্তা, ভাবনা ও মননজগতেও দেখা দিয়েছিল এক অনন্যসাধারণ প্রাচুর্যের পর্ব। বাঙালি মনীষীরা জীবন ও জগতের বিচিত্র বিষয় নিয়ে যে কেবল উন্নত ও ঋদ্ধ চিন্তা করেছেন তা-ই নয়, বৈচিত্র্যে ও গভীরতায় উজ্জ্বল সেই চিৎসম্পদের ফসল দিয়ে এই জাতির মনন-ভান্ডারকে সমৃদ্ধও করেছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আরও বলেন, 'গত ২০০ বছরে বাঙালি মনীষী ও চিন্তাবিদেরা শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সাহিত্য দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে যেসব চিন্তামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন সেগুলোকে বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে দুশোর অধিক খণ্ডের একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে আমরা এটি প্রকাশ করতে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে যেসব মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালির চিন্তাশীল রচনার বিষয়ে আগ্রহী হবেন বা সেসব নিয়ে গবেষণা করতে চাইবেন, তারা এ সংক্রান্ত অধিকাংশ লেখা এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে পাবেন।'

যে বিষয়গুলো নিয়ে বইগুলো প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলো হলো- অর্থনীতিচিন্তা, ইতহাসচিন্তা, চলচ্চিত্রচিন্তা, দর্শনচিন্তা, ধর্মচিন্তা, নারীচিন্তা, পরিবেশচিন্তা, বিজ্ঞানচিন্তা, ভাষাচিন্তা, রাজনীতিচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা, শিল্পচিন্তা, সংগীতচিন্তা, সংস্কৃতিচিন্তা, সমাজচিন্তা ও সাহিত্যচিন্তা।

এখন পাওয়া যাবে ইতিহাসচিন্তা, দর্শনচিন্তা, নারীচিন্তা, বিজ্ঞানচিন্তা ও সংস্কৃতিচিন্তার খণ্ডগুলো।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহের সম্পাদনা করেছেন ২১ জন সম্পাদক। এর মধ্যে রাজনীতি ও সাহিত্যের ৩২ খণ্ড করে মোট ৬৪টি বই, ধর্ম ও দর্শনচিন্তার প্রকাশ হবে ২০ খণ্ড করে ৪০টি বই। অন্যান্য ১২টি বিষয়ে প্রকাশ হবে বাকি গ্রন্থগুলো।

অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্যের পর গ্রন্থমালার অন্য সম্পাদকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মোড়ক উন্মোচন করেন। পরে সম্পাদকরা মঞ্চে উঠে তাদের নিজ নিজ কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। পাশাপাশি কাজটি করতে গিয়ে তারা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেগুলো উপস্থিত অতিথিদের জানান।

এ পর্যায়ে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ নিয়ে নিজেদের অনুভূতির কথা জানান অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম।

বিপুল কলেবরের এই কাজটিকে একইসঙ্গে 'অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব' অভিহিত করে তারা বলেন, বাঙালির ২০০ বছরের ভাবনার এই রূপরেখা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য চিরস্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে।

পরে ভিডিও বার্তায় কাজটি নিয়ে কথা বলেন সাহিত্যিক আনিসুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

এ ব্যাপারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষ্য, 'এই বইয়ের বাজারমূল্য নেই। এই বই সংগ্রহের, ব্যবহারের।' এ সময় রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, 'মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য যা প্রয়োজন তার মধ্যে গ্রন্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের মধ্যে মানুষের চিন্তার খবর থাকে, হৃদয়ের নৈতিক খবর থাকে।

'এই সংগ্রহ পাঠাগারে থাকবে। কিন্তু একজন পাঠক জানবে যে ওই পাঠাগারে গেলে এই বইগুলো পাওয়া যাবে এবং কোথায় কোন খণ্ডে তার কাঙ্ক্ষিত রচনা পাওয়া যাবে সেটা সে খুঁজে নেবে।'

Comments