খামারবাড়ির মণ্ডপ ‘ইকোফ্রেন্ডলি’, দুর্গা ‘স্মার্ট’

পুরো মণ্ডপে ব্যবহার করা হয়েছে তিন হাজার বাঁশ, ১৮ হাজার ৭৫০ বর্গফুটের বাঁশের বেড়া ও ছয় হাজার বর্গফুট চাটাই। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির বাহক। সেই পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক কতটা ক্ষতিকর সেটা কমবেশি সবার জানা। কিন্তু পুরোপুরি প্লাস্টিক ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণসামগ্রী ছাড়াই কোনো স্থাপনা ঠিক কেমন হতে পারে তার জবাব মিলবে ঢাকার খামারবাড়ির সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘের পূজামণ্ডপে।

প্রতি বছর দুর্গাপূজায় খামারবাড়ির এই মণ্ডপ তৈরিতে ধারার বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী কিছু করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এবারও সাবেকিয়ানা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন এই মণ্ডপটিকে আলাদা মাত্রা দিতে যাচ্ছে।

গত শতকের সত্তরের দশক থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এবার খামারবাড়ির পুরো মাতৃমণ্ডপ তৈরি হয়েছে বাঁশ, বাঁশের তৈরি চাটাই ও বেড়া দিয়ে, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলার লোকশিল্পের সেই আদি ঐতিহ্যকে।

এর সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে মণ্ডপে বসানো হয়েছে 'রোবটিক' দুর্গা প্রতিমা। মহিষাসুর বধের সচল চিত্র তুলে ধরা হবে এই প্রতিমার মধ্য দিয়ে।

দুর্গা হবেন রোবোটিক। মহিষাসুর বধের সচল চিত্র তুলে ধরা হবে এই প্রতিমার মধ্য দিয়ে। ছবি: স্টার

কালে কালে বাঙালির দুর্গাপূজা নানা রূপ ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কেবল ধর্মের বিষয় না থেকে সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এ ধারাবাহিকতায় দুই বাংলাতেই থিম পূজার রমরমা চলছে অনেক বছর ধরে। মূলত এর মাধ্যমে 'পূজার ছলে' নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তাও দেওয়া হয়।

খামারবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজক সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, 'স্মার্ট বাংলাদেশ, লাভ ফর নেচার'—এই স্লোগানকে সামনে রেখে তারা এবার পুরো আয়োজনটি সাজিয়েছেন। ঐতিহ্যের সঙ্গে থিম-শিল্পের মিশেল ও আধুনিকতা তাদের এবারের পূজার মূল আকর্ষণ। তাই তারা এবার একইসঙ্গে মণ্ডপ নির্মাণ ও সাজসজ্জায় যেমন আশ্রয় নিয়েছে হারাতে বসা বাংলার লোকশিল্পের, তেমনি বর্তমান সময়কে ধরতে দুর্গা প্রতিমাটি তৈরি করেছেন রোবোটিকরূপে।

গত ১৪ অক্টোবর দেবীপক্ষে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আসার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে শুরু হয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

আশ্বিনের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় দেবীপক্ষ; দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। সাধারণত শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

এই পাঁচদিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। ২০ অক্টোবর শুক্রবার শুভ বিল্বষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে।

মহালয়ার দিনে খামারবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মণ্ডপে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। পুরো মণ্ডপ ও এর সাজসজ্জায় গ্রামীণ পরিবেশের আদল।

মণ্ডপের নকশাদার ছাদ। ছবি: স্টার

মণ্ডপের নকশাকার ও প্রতীমাশিল্পী ভাস্কর উত্তম কুমার রায় দ্য ডেইলি স্টারকে জানালেন, মণ্ডপের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে তিন হাজারের বেশি বাঁশ। এর সঙ্গে নকশার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৫০ বর্গফুটের বাঁশের বেড়া ও গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি ছয় হাজার বর্গফুট চাটাই। আছে শীতলপাটির ব্যবহারও।

মণ্ডপের ভেতরে দাঁড়িয়ে উত্তম বললেন, 'খেয়াল করে দেখুন, ইট-সিমেন্টের তৈরি অন্য স্থাপনার তুলনায় এই মণ্ডপের ভেতরের তাপমাত্রা অনেক কম। বাঁশ ব্যবহারের কারণে এমনটি সম্ভব হয়েছে। সেইসঙ্গে চাটাই, বেড়া ও শীতলপাটির ব্যবহার পুরো মণ্ডপকে গ্রামীণ আবহ দিয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় দিন দিন গোটা পৃথিবী যেভাবে সরব হয়ে উঠছে, এর সঙ্গে সংহতি জানাতেই আমাদের এবারের এই আয়োজন।'

তিনি আরও জানান, দুর্গা প্রতীমার ব্যাকগ্রাউন্ডটাও সাজানো হচ্ছে বাঁশ-চাটাইয়ের নকশাদার ফ্রেমে।

এখানেই কথা হয় সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘের সভাপতি সমীর চন্দের সঙ্গেও। তিনি বলেন, 'মা দুর্গা যখন ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করবেন, তখন মহিষাসুর তীব্র যন্ত্রণায় মা দুর্গার কাছে দুই হাত তুলে ক্ষমা চাইবে। মা সে সময় বলে উঠবেন, "যুগে যুগে আসুরিক শক্তি দমনে আমার এই জগতে আগমন।" সঙ্গে থাকবে আবহসংগীত।'

সমীর চন্দের দাবি, পরিবেশ সচেতনতার জায়গা থেকে পুরো মণ্ডপের কোথাও এক টুকরো প্লাস্টিক কিংবা সিনথেটিক ব্যবহার করেননি তারা।

কর্মযজ্ঞ। ছবি: স্টার

এসবের পাশাপাশি মণ্ডপ ও সংলগ্ন সড়কগুলোয় আলোকসজ্জার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ পটভূমির ব্যবহার থাকবে বলে জানান তিনি। বলেন, 'সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘের এই মণ্ডপে সরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থার বাইরে আমাদের নিজেদের ১০০ স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবেন। থাকবে ১০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা।'

সনাতন আচার অনুসারে মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা—এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব।

পঞ্জিকা অনুযায়ী এবার ২০ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন; দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। পরদিন শনিবার সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার। অষ্টমী ও নবমী শেষে ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের।

শাস্ত্র বলছে, দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যে আসবেন ঘোড়ায় চড়ে। ফিরবেনও একইভাবে। এর অর্থ হচ্ছে এবার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা দেবে। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যু বাড়বে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের হিসাবে, এবার দেশে ৩৩ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে, যার মধ্যে ঢাকায় আছে ২৪৪টি।

Comments

The Daily Star  | English

Why are onion prices rising abruptly?

Onion prices have been increasing over the past weeks, as farmers and traders release fewer stocks to local markets in the hope of better returns amid the government’s suspension of imports

2h ago