কেন রাজপথে নেমেছিলেন নূর হোসেন

শহীদ নূর হোসেন। ছবি: পাভেল রহমান

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে যাওয়া শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগের মহিমা বিধৃত হয়েছে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর এক নাতিদীর্ঘ ভাষ্যে।

কবি শামসুর রাহমান ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান রচিত 'শহীদ নূর হোসেন' গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের অগ্রদূত এই শিল্পের যোদ্ধা।

ওই গ্রন্থের ভূমিকায় কাইয়ুম চৌধুরী লেখেন, 'বুক ভরে মাটির গন্ধ নেওয়ার জন্য, উদাত্ত কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য, ক্যানভাসে স্বপ্নের ছবি আঁকার জন্য, কবিতায় জীবনের ফুল ফোটানোর জন্য রাজপথে নেমে এসেছিলেন যে তরুণ, বুকের রক্তে লিখে রেখে গেলেন মানবতার শত্রু "স্বৈরাচার নিপাত যাক", "গণতন্ত্র মুক্তি পাক"।'

নূর হোসেনকে বাংলাদেশে 'গণতন্ত্রের পতাকা হাতে এগিয়ে আসা একজন' হিসেবে অভিহিত করে কাইয়ুম চৌধুরী আরও বলেন, 'যে দেশে মানবতা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় প্রতিনিয়ত, সে দেশে এই আত্মদান আমাকে বিমূঢ় করে, গর্বিত হই অন্তরে, উজ্জীবিত হই প্রাণে।'

নূর হোসেন এমনই একজন, যিনি জীবন্ত পোস্টার হয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে স্লোগানের অক্ষরে বুকে-পিঠে ধারণ করেছিলেন।

ঢাকার নারিন্দায় এক অটোরিকশা চালকের ঘরে জন্ম নেওয়া নূর হোসেন ছিলেন যুবলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষে নূর হোসেন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন।

জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ১৯৮৭ সালের এই দিনে নূর হোসেন বুকে ও পিঠে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান লিখে রাজপথে বের হয়েছিলেন।

সেদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল পল্টন এলাকার 'জিরো পয়েন্ট'অতিক্রম করার সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুঁড়ে মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন নূর হোসেন ও যুবলীগ নেতা বাবুল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর শেখ হাসিনার গাড়ির সামনের অংশে বুকে স্লোগান লেখা নূর হোসেন। ছবি: দিনু আলম

নূর হোসেনের সেদিনের আত্মত্যাগ মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল। বুকে-পিঠের স্লোগানসংবলিত তার শরীর হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের প্রতীক।

ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আরও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।

নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পর মাস না পেরোতেই ৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এরশাদ। এর তিন মাস পর তিনি জাতীয় সংসদের আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বড় দলগুলো না নেওয়ায় ওই সংসদ রাজনৈতিক বৈধতা পায়নি।

এরশাদ এরপরও ক্ষমতায় টিকে ছিলেন পৌনে তিন বছর। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ঘটনাবহুল একটি দশক শেষ হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।

আজ থেকে ৩৬ বছর আগে যে জায়গাটিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলে নূর হোসেন সেই জিরো পয়েন্ট এখন নূর হোসেন চত্বর। তার স্মরণে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। তার রক্তে এ দেশের গণতন্ত্র কতটুকু এগিয়েছে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে।

বিএনপি দিনটি পালন করে 'ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস' হিসেবে। আর আওয়ামী লীগ দিনটিকে পালন করে আসছে 'নূর হোসেন দিবস' হিসেবে।

এবারও নূর হোসেনের আত্মাহুতির দিনে নানা আয়োজন রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

তবে ২০১২ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে তার মা মরিয়ম বিবি বলেছিলেন, 'আমার ছেলে যে জন্য প্রাণ দিল, তা অর্জিত হয়নি। তবে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি নূর হোসেনের জন্য গর্ব অনুভব করি।'

নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পর কবিতায় শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়/ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ/বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে...।'

আবার কাছাকাছি সময়ে রচিত 'একজন শহীদের মা বলছেন' কবিতায় শামসুর রাহমান নূর হোসেনকে নিয়ে বলে ওঠেন, 'হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই/তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর/করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ/ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা/তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ/জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে/জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,/ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু।'

শহীদ নূর হোসেন এভাবেই বার বার ফিরে এসে আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণ মনে স্মৃতির কড়া নেড়ে যান।

Comments

The Daily Star  | English
Chattogram port Imports

Reducing penalty on false declarations will encourage smuggling: experts

In the Finance Ordinance 2025–26, presented on Monday, the government proposed amending the Customs Act 2023 and revising the penalty structure for tax evasion related to intentional false declarations during import clearance, reducing the minimum fine from twice the evaded amount to an equivale

2h ago