রিকশার ইতিহাস ও রিকশাচিত্রের আদ্যোপান্ত
সম্প্রতি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র। তিন চাকার এই বাহনটি ঢাকাসহ সারাদেশে অত্যন্ত প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও এটি আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবন নয়।
বেশিরভাগ গবেষকের মতে, রিকশার উদ্ভাবন হয়েছে জাপানে। জাপানি শব্দ 'জিনরিকিশা' থেকে এসেছে রিকশা। জাপানি ভাষায় 'জিন' শব্দের অর্থ 'মানুষ', 'রিকি' অর্থ 'শক্তি' আর 'শা' অর্থ 'বাহন'। ফলে 'জিনরিকিশা'র অর্থ দাঁড়ায়- মানুষের শক্তিতে চালিত বাহন।
কেউ কেউ রিকশা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রকে। তবে কলকাতায় প্রচলিত হাতে টানা রিকশার মতো ছিল না পূর্ববঙ্গের রিকশা।
ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন তার 'ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী' বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে প্রচলিত প্যাডেল দেওয়া সাইকেল রিকশা এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে।
শুরুর দিকে কোনো রিকশাই তিন চাকায় চালিত ছিল না। সামনে থাকতো লম্বা হাতল, চাকা থাকতো দুটি। হাতল ধরে হেঁটে বা দৌড়ে এই রিকশা টেনে নেওয়া হতো।
গবেষক এম উইলিয়াম স্টিলির 'রিকশা ইন সাউথ এশিয়া, ইন্ট্রোডাকশন টু স্পেশাল সেকশন' গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৮৬৯ সালে জাপানে কাহার-টানা পালকির বদলে রিকশা চালু হয়। তখন দেশটিতে মেজি সাম্রাজ্যের শাসন চলছে। এরপর সেখান থেকে চীন, হংকং ও সিঙ্গাপুরে ছড়িয়ে যায় রিকশা।
উৎপত্তি জাপানে হলেও এর নকশা করেছিলেন জোনাথন স্কোবি নামে মার্কিন এক খ্রিষ্টান মিশনারি। পঙ্গু স্ত্রীকে ইয়োকোহামা শহর ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে ১৮৬৯ সালে 'জিনরিকিশা' বাহনটি তৈরি করেন তিনি।
তবে বিভিন্ন গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের এই রিকশা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে।
যাই হোক, সেসব দেশে কিন্তু এখন আর রিকশার প্রচলন নেই। জাপানি ভাষায় এর আরেক নাম ছিল 'নিনতাকু'। তবে গত শতকের পঞ্চাশ দশকের ভেতরই জাপান থেকে রিকশার প্রচলন উঠে যায়।
১৮৮০ সালে মিশনারি রেভারেন্ট জোর ফরডাইস রিকশা নিয়ে আসেন ভারতে। ১৯০০ সালে সেই রিকশা আসে কলকাতায়। তবে তখন সাধারণ যাত্রী নয়, বরং মালামাল টানার জন্যই এর ব্যবহার ছিল।
পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রিকশা এসেছিল চট্টগ্রামে। সেটি আনা হয়েছিল মিয়ানমারের রেঙ্গুন থেকে। ঢাকায় প্রথম রিকশা আসে ত্রিশের দশকে ভারতের কলকাতা থেকে। তবে মুনতাসীর মামুনের মতে, এই রিকশা হাতে টানা নয়, বরং সিঙ্গাপুরে উদ্ভাবিত প্যাডেল রিকশা।
ঐতিহাসিক মোমিনুল হক তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ১৯৪০ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের পাট কোম্পানি রেলি ব্রাদার্সের এক কেরানি কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জে একটি রিকশা নিয়ে আসেন। এর মালিক ছিলেন যদু গোপাল দত্ত। প্রথম রিকশাচালকের নাম ছিল নরেশ।
১৯৪১ সালে ঢাকায় রিকশা ছিল মাত্র ৩৭টি। পৌরসভার তথ্যমতে, ১৯৯৮ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৫৭২-টিতে।
রিকশার ইতিহাস নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। এবার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া রিকশাচিত্রে দৃষ্টি ফেলা যাক।
১৯৪৭ সালে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ছিল ১৮১টি। পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে রিকশায় চলচ্চিত্রের নানা দৃশ্য ও অভিনয়শিল্পীদের মুখ আঁকা হতে থাকে। সেসময় পাকিস্তান ও ভারত- উভয় দেশের ছবি উভয় দেশে মুক্তি পেতো। তাই রিকশায় আঁকা ছবিগুলো সাধারণত হতো বিভিন্ন সিনেমার পোস্টারের আদলে। এর পেছনে প্রভূত অবদান রেখেছেন সুনীল, আর কে দাস, আলীনূর, আলাউদ্দীন, দাউদ ওস্তাদ, রাজকুমার দাস, মো. হানিফ ওরফে পাপ্পু ওস্তাদ এবং মো. রফিকুল ইসলামের মতো শিল্পীরা।
তবে অঞ্চলভেদে রিকশাচিত্রে পার্থক্য দেখা গেছে। ঢাকায় যেমন সিনেমার তারকাদের মুখ আঁকা হয় নীল বা গোলাপি রঙে, তেমনি সিলেটের দিকে ধর্মীয় বাণী, খুলনার দিকে ট্রেন চালনা বা বিমান উড্ডয়নের ছবি দেখা যায়। আবার ষাটের দশকের শেষদিকে রিকশায় মানুষের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে শিল্পীরা ঝুঁকে পড়েন পশুদের ছবি এঁকে কাহিনী ফুটিয়ে তোলায়। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের মাঝামাঝিতেও একবার এসেছিল এমন নিষেধাজ্ঞা। তবে এরপর আবারো রিকশাচিত্রে সমহিমায় ফিরে আসে চিত্রনায়ক-নায়িকারা।
বর্তমানে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যবসা রমরমা হওয়ায় রিকশাচিত্রের প্রচলন অনেক কমে গেছে। পুরান ঢাকায় এখন সর্বসাকুল্যে ১৫ জনের মতো শিল্পী রিকশাচিত্রের কাজ করেন। তাদের মধ্যে নারিন্দার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম অন্যতম।
১৫ বছর বয়স থেকেই এই শিল্পে হাতেখড়ি তার। তখন ক্লাস নাইনে পড়তেন। মামা আলাউদ্দীন ছিলেন বিখ্যাত রিকশাচিত্রশিল্পী। তার সঙ্গে এই কাজ শুরু করেন তিনি। সে আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। দুই-তিনমাস মামার সঙ্গে কাজ করে হাতযশ আসে তার।
ইতোমধ্যে রিকশা পেইন্টিংয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন রফিকুল। অংশ নিয়েছেন জাপানে আয়োজিত প্রদর্শনীতে।
তার কাছ থেকে জানা গেল, সাধারণত ছবির জন্য যে অ্যাক্রেলিক রঙ ব্যবহৃত হয়, তা রিকশাচিত্রে ব্যবহৃত হয় না। এ ক্ষেত্রে অ্যানামেল রঙ ব্যবহৃত হয়। এই রঙের সঙ্গে তারপিন ও কেরোসিন মিশিয়ে তুলির আঁচড় দেওয়া হয়। একটি রিকশাচিত্র সম্পন্ন করতে প্রায় এক-সপ্তাহ লাগে।
রফিকুল জানান, অ্যাক্রেলিক রঙ কাপড়ের ওপর ব্যবহার করা যায় না, কাপড় শক্ত হয়ে গেলে রঙ শুষে নেয়। তবে অর্ডার এলে সেভাবে ওই রঙ দিয়েই কাজ করেন তারা।
রফিকুল জানান, সাধারণত যে ছবি ২৫০০-৩০০০ টাকায় বিক্রি হয়, তা রিকশার জন্য আঁকলে পাওয়া যায় মোটে ৫০০ টাকা।
বর্তমানে রিকশাচিত্র নিয়ে কাজ করছে নানা সংগঠন। লোকজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এই শিল্পের সঙ্গে তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান ভিজুয়াল আর্টিস্ট বিস্কুট আবির। 'বিস্কুট ফ্যাক্টরি' নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। কাজ করছেন লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে।
তিনি বলেন, 'আমাদের লোকজ সংস্কৃতির যে দিকগুলো অবহেলিত, সেসবের সঙ্গে আমরা তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। সম্প্রতি ইউনেস্কো রিকশাচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ায় অনেকে এটি নিয়ে উৎসাহী হয়েছেন। তবে শুধু রিকশাচিত্রই না, লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান নিয়ে আমরা ২০০৯ সাল থেকে কাজ করছি। রিকশায় যে ধরনের ছবি দেখা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে আমরা টি-শার্ট, জুতা, কেটলি ও সানগ্লাসসহ অনেক কিছুতে রিকশার ছবিগুলো প্রিন্ট করেছি। এতে এই সংস্কৃতি সম্পর্কে তরুণদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, অনেক মানুষ এ বিষয়ে জানতে পারছেন।'
'আমি চাই ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর শুধু নয় বরং আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, যেমন- যাত্রা, রিকশা পেইন্ট সম্পর্কে মানুষ আগে থেকেই জানুক, ক্রাফট মার্কেটে এর ভ্যালু তৈরি হোক। সেভাবেই আমরা কাজ করছি', যোগ করেন তিনি।
এই ভিজুয়াল আর্টিস্ট বলেন, 'লোকাল আর্টিস্ট বা লোকাল মার্কেট নিয়ে অনেকের হীনমন্যতা কাজ করে। আমরা চাই তরুণেরা সেটি কাটিয়ে উঠুক, আমাদের শিল্পীদের মূল্যায়ন হোক।'
'ইউনেস্কো যাকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে, সেই রিকশাচিত্র সংরক্ষিত হোক, জাদুঘরে নয় বরং মানুষের কাছে ঠাঁই পাক, ব্যাপকভাবে পৌঁছে যাক- এটিই আমাদের প্রত্যাশা', বলেন তিনি।
Comments