ইতিহাস ও ফ্যাশনে ঢাকার রিকশাচিত্র

রিকশাচিত্র
ছবি: স্টার লাইফস্টাইল আর্কাইভ

সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্রকে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সম্মান ও প্রাপ্তি।

ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্রের নান্দনিক উপস্থাপনা বহু বছর ধরে সৌন্দর্যপিপাসুদের মনের খোরাক জোগাচ্ছে। রিকশা সারা বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে এই বাহনটির বিশেষ সম্পর্ক আছে।

বর্তমানে আমরা যে রঙিন রিকশা দেখি, তার সূত্রপাত হয়েছিল মূলত যাত্রী আকর্ষণের উপায় হিসেবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের তুলির আঁচড়ে রিকশাচিত্র ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রিকশাচিত্র ছাড়া রিকশা কল্পনা করাই দুরূহ হয়ে পড়ে। সময়ের পরিক্রমায় রিকশাচিত্র আমাদের দেশীয় শিল্প ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এর সুনাম বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তারই অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি এলো।

রিকশাচিত্রের ইতিহাস

ইতিহাসবিদরা বলেন, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের আগে ঢাকায় রিকশা ও রিকশাচিত্রের প্রচলন হয়। বিষয়বস্তু ও চিত্রের ধরন বিবেচনায় নিলে সে সময়কার সিনেমার পোস্টারের সঙ্গে এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ১৯৪১ এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ এবং ১৮১। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায় (সূত্র: বাংলাপিডিয়া)।

রিকশাচিত্রঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র
ছবি: স্টার লাইফস্টাইল আর্কাইভ

রিকশার জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রিকশাচিত্রের জনপ্রিয়তাও। মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাতেই এই শিল্পের হাতেখড়ি। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় গণহত্যা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরদের ছবি রিকশাচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। সত্তরের দশকে মাঝামাঝিতে এসে সিনেমার তারকা ও সাধারণ মানুষের ছবি রিকশাচিত্রে স্থান পেতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় রিকশার গায়ে কাল্পনিক প্রাণীর ছবিও আঁকতে শুরু করেন চিত্রশিল্পীরা। এটি ছিল রিকশাচিত্রের জন্য এক উল্লেখযোগ্য মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।

আশির দশকের শুরুতে সিনেমার তারকারা আবারও রিকশাচিত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পেতে শুরু করেন। তারকাদের সানগ্লাস পরা ছবি, আইকনিক চুল, লাল টকটকে গাল এবং বিশাল চোখ দর্শকদের মোহিত করত! রিকশাচিত্রে সিনেমার তারকাদের প্রাধান্য থাকলেও বড় বড় শহরের রিকশায় তাজমহল, প্রাণী, ফুলেল নকশা, ধর্মীয় বিষয়াদি, গ্রামীণ পটভূমি এমনকি উড়োজাহাজের চিত্রও নিয়মিতই দেখা যেত।

ফ্যাশনেও রিকশাচিত্র

রিকশাচিত্রের ইতিহাস
ছবি: স্টার লাইফস্টাইল আর্কাইভ

রিকশাচিত্র শুধু রিকশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ফ্যাশনের জগতেও এর উল্লেখযোগ্য ছাপ রয়েছে। বহু বছর ধরে শহরবাসীর মন জয় করতে পারলেও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আসবাবপত্রে রিকশাচিত্রের ব্যবহার শুরু হয় ২০০০ এর দশক থেকে। নতুন শতকের প্রথম থেকেই জামা কাপড়ে রিকশাচিত্রের ব্যবহার জনপ্রিয় ও নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসেবে চালু হয়। আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী পোশাকেও রিকশাচিত্রের ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকেই।

রিকশাচিত্রে সাধারণত গাঢ় রং ব্যবহার করে ফুল, পাখি এবং প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান আঁকা হয়। হলুদ, লাল, নীল ও সবুজ রঙের সমন্বয়ে আঁকা চিত্রগুলো রিকশাচিত্রের মূল প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে, যা বাংলাদেশিদের অত্যন্ত পছন্দ।

বর্তমানে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, কুর্তিসহ অন্যান্য পোশাকে রিকশাচিত্রের দেখা মেলে। আড়ং, চন্দন, যাত্রাসহ স্থানীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর সৌজন্যে ফ্যাশন জগতে রিকশাচিত্র এখন বিখ্যাত নকশায় পরিণত হয়েছে।

ইতিহাস ও ফ্যাশনে ঢাকার রিকশাচিত্র
ছবি: স্টার লাইফস্টাইল আর্কাইভ

গৃহস্থালি ও আসবাবে রিকশাচিত্র

রিকশাচিত্র আঁকা গৃহসজ্জার বিভিন্ন আসবাব শহরের বিভিন্ন দোকানেই পাওয়া যায়। ফুলের নকশা বা শহরের দৃশ্য আঁকা কুশন কভার খুব সহজেই আপনার বাড়ির চেহারা বদলে দিতে পারে। দুপুর বা বিকেলে যেখানটায় বসে চা পান করেন, সেখানেও রিকশাচিত্র নান্দনিকতা যোগ করতে পারে। 

আশির দশক থেকেই শিল্পপ্রেমীরা দেয়ালে টানানোর জন্য রিকশাচিত্র সংগ্রহ করতেন। তবে এখন অনেকেই বাসার আসবাবেও রিকশাচিত্রকে স্থান দিচ্ছেন। আপনি শিল্প অনুরাগী হয়ে থাকলে বাসার দেয়ালেও রিকশাচিত্রের মতো নকশা করতে পারেন।

বছরের পর বছর ধরে রিকশাচিত্রে শুধু আমাদের চলচ্চিত্র জগতের তারকা, ফুল, পাখি ও প্রকৃতিই স্থান পায়নি, আমাদের রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিক পটপরিবর্তনের সাক্ষীও এটি। রিকশাচিত্রে আমাদের দেশের মানুষের কথা বলে, এই অনন্য শিল্পটি সম্পূর্ণভাবেই আমাদের। 

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

1h ago